এক আল-কোরআন থেকে ইসলামের যাত্রা শুরু। অথচ আজ আমাদের সামনে ইসলাম সম্পর্কে কত লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গ্রন্থ বিদ্যমান! এ যাবত ইসলাম সম্পর্কে ঠিক কত সংখ্যক গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট হিসাব কারো জানা নেই। এ মহান দ্বীন সম্পর্কে কত তাফসীর, কত হাদীস, কত সীরাত, কত উসূল, কত আদাব, কত লোগাত, কত শারাহ্, কত ফাতাওয়াহ গ্রন্থ রচিত হয়েছে তা অজান। এ সম্পর্কে না আছে কোন সঠিক পরিসংখ্যান, না আছে কোন তথ্য। জ্ঞানের জগতে ইসলামের এ এক বিস্ময়কর অর্জন।
ইসলাম সম্পর্কে আমরা কত গ্রন্থই না পাঠ করি। কত মুফাচ্ছির, কত মুহাদ্দিস, কত ফকীহ, কত মুফতি, কত মুফাক্কির, কত ইতিহাসবিদ, কত চিন্তাবিদের লেখাই না আমরা অধ্যয়ন করি। আবার যারা ইসলামের বিরোধিতা করেছে এবং সমালোচনা করেছে, তাদের গ্রন্থও কম-বেশি অধ্যয়ন করে থাকি। হ্যাঁ, আমাদেরকে সে সব গ্রন্থও পাঠ করতে হবে। কিন্তু সর্বাগ্রে পাঠ করতে হবে ইসলামের উৎসগ্রন্থ আল-কোরআন এবং তা পাঠ করতে হবে গভীর মনোযোগ ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। এ বিষয়ে কোন প্রকার ফাঁকিবাজি এবং অলসতা করা চলবে না। কেননা কোরআন পাঠ করা ব্যতীত আমরা কখনো ইসলামের সঠিক পরিচয় জানতে পারবো না এবং সঠিক ইসলামের সন্ধান পাবো না। এখন প্রশ্ন হল- বাস্তবে কতজন মুসলিম আছেন, যারা পবিত্র কোরআন জীবনে একবার হলেও সম্পূর্ণ অধ্যয়ন করেছেন ? উত্তর হল- এ সংখ্যা খুবই সীমিত। তাহলে আমরা বলতে পারি ইসলামের প্রকৃত পরিচয় খুব অল্পসংখ্যক লোকের কাছে রয়েছে।
পবিত্র কোরআন জীবনে অন্ততঃ একবার সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করা ব্যতীত কেউ ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখার দাবী করতে পারেন না। যদি কেউ সে দাবী করে থাকে, তবে তা সঠিক নয়! এটা কী করে সম্ভব যে, মূল গ্রন্থ একবারও পাঠ না করে শুধুমাত্র তার উপর লিখিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাঠ করে নিশ্চিত জ্ঞান লাভের দাবী করা যায়? এ দাবি অযুক্তিক এবং বাস্তবসম্মত নয়।
মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালগুলোতে পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করানো হয় না। বিভিন্ন ক্লাশে কোরআন এবং হাদীসের নির্বাচিত অংশ পড়ানো হয়। সুতরাং কোথাও পরিপূর্ণ ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হয় -একথা বলা যাবে না। এমতাবস্থায় যারা ইসলাম সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে চায় এবং প্রকৃত ইসলাম আত্মস্থ করতে চায়, তাদের জন্য প্রথম করণীয় হল- নিজ উদ্যোগে কমপক্ষে একবার হলেও পবিত্র কোরআন গভীর মনোযোগ সহকারে সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করা। এছাড়া যারা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানচর্চা করতে চায়, তাদের জন্য বারংবার এ গ্রন্থ পাঠ করার কোন বিকল্প নেই।
যারা সমগ্র জীবন ইসলামের খিদমতে ব্যয় করেছে বলে দাবী করে, অথচ জীবনে একবারের জন্যও পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করে দেখেনি, তাদের জন্য আফসোস! তারা না পেরেছে সঠিকভাবে আল্লাহকে চিনতে আর না পেরেছে ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে। যেমন, যারা গভীর মনোযোগ সহকারে আল্লাহর কালাম পরিপূর্ণ অধ্যয়ন করেছে এবং যারা তা করেনি -তাদের মাঝে কিছু গুরুতর পার্থক্য দেখা যাবে। যেমন- ইসলামের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে অদক্ষতা, ফরজ চিহ্নিত করতে না পারা, হুকুমসমূহের গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারা, জীবনের গতিপথ বুঝতে না পারা ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিয়ম-নীতি (সুনান) সম্পর্কে না জানা।
কোরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে কেউ কেউ বলে থাকেন যে, তাফছির ব্যতীত কোরআন অধ্যয়ন করা উচিৎ নয় -এতে পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটি ভুল কথা। কোরআন-সুন্নাহর কোথাও এমন বিধি-নিষেধ, পরামর্শ অথবা আশংকার কথা পাওয়া যায় না। তবে যাদের ভাষা আরবি নয় এবং যারা আরবী বুঝে না, তাদের জন্য কোরআন অধ্যয়নে প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে বোধগম্য নয় বা বুঝে আসে না এমন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলিমদের সহায়তা নিতে হবে। কোরআনে এ মর্মে বলা হয়েছে- “তোমরা জ্ঞানী লোকদেরকে জিজ্ঞাসা কর।”
কোরআন অধ্যয়নের ক্ষেত্রে শুরুতেই তাফসীরের অনুসরণ করা অথবা শুধুমাত্র একটি তাফছির অনুসরণ করা সঠিক পন্থা নয়। এতে ইসলাম সম্পর্কে একমুখী চিন্তার অধিকারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য করণীয় হল- প্রথমতঃ সরাসরি অনুবাদ পড়া। এরপর জটিল বিষয়সমূহের জন্য তাফছিরের সাহায্য গ্রহণ করা এবং অবশ্যই একাধিক তাফছিরের ব্যাখা অনুসন্ধান করা। এদিকে ইঙ্গিত করে সালাফগণ বলেছেন, ‘-এমনভাবে কোরআন অধ্যয়ন কর, যেন তা তোমার উপর অবতীর্ণ হচ্ছে।’ সত্যি এই কোরআন তো আল্লাহ তাঁর প্রত্যেক বান্দাহকে লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ করেছেন এবং এ মর্মে মুহুর্মুহু ডাক এসেছে- ‘হে মানবজাতি’, ‘হে বিশ্বাসীগণ’, ‘হে অবিশ্বাসীগণ’। এককথায় প্রত্যেক মানুষের উদ্দেশ্যে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।