এক.

মহা মূল্যবান এক সম্পদের নাম- ঈমান। পৃথিবীর আপাতঃ ক্ষমতা, নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, সম্পদ ও মর্যাদার কোনটি অথবা এর সবগুলো একসাথেও ঈমানের সমকক্ষ নয়। এজন্য দেখা যায়- যাদেরকে ঈমান দান করা হয়েছে তারা জীবন-জীবিকা, সুখ-শান্তি, সহায়-সম্পদ, ঘর-বাড়ি, সন্তান-সন্তুতি, আত্মীয়-স্বজন ও মান-সম্মান নিঃসংকোচে বিলিয়ে দেয় কিন্তু কখনো ঈমান বিসর্জন দেয় না। জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিষ্পেষণ, অন্যায়-অবিচার, সম্ভ্রমহানি, হুমকি-ধমকি এবং শত চাপের মুখেও নতি স্বীকার করে না। তারা কারাবরণ করে কিন্তু নীতি-আদর্শ থেকে একটুও সরে যায় না। আঘাত সয়, আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়, বুলেট লুফে নেয়, ফাঁসিতে ঝুলে এবং অকাতরে জীবন দেয়, কিন্তু ঈমান বিক্রি করে না। এ সকল মানুষ হচ্ছে তাঁরা, যাঁরা একথা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে- ঈমান হল জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ! প্রকৃতই পৃথিবীর সমস্ত সুখ, সমৃদ্ধি ও সম্মান লাভ করেও যারা তাদের মহান স্রষ্টাকে চিনতে পারেনি, তাঁকে আবিষ্কার করতে পারেনি, তাঁর সার্বভৌমত্ব, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও শক্তিমত্তাকে উপলব্ধি করতে পারেনি, তাঁর হুকুম-আহকাম সঠিকভাবে মেনে চলতে পারেনি এবং পরকালীন জীবনে তাঁর পুরস্কার ও শাস্তির ঘোষণার উপর নিজের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখতে সক্ষম হয়নি; তাদের মত বিপদগ্রস্ত, পরাজিত, অসহায় ও করুণার পাত্র আর কারা আছে? যদিও পৃথিবীতে তারা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত থাকে।

দুই. 

ঈমান গ্রহনের সাথে সাথে ঈমানদার ব্যক্তি এমন এক মহাশক্তিধর প্রভূর সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে যায়, যিনি সমগ্র কুল-কায়েনাতের একমাত্র স্রষ্টা ও নিয়ন্তা। যিনি সকল বিষয়ে নির্ভরতার একমাত্র প্রতীক। যিনি সবকিছুর রক্ষক, পরিচালক ও বিচারক। যিনি সৃষ্টির মাঝে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব করেন না এবং কারো প্রতি জুলুম করেন না। যিনি বিদ্বেষ পোষণ করেন না এবং কাউকে তাঁর ব্যাপারে বাধ্য করেন না। যিনি পরম ধৈর্যশীল এবং পরম দাতা ও দয়ালু। প্রত্যেকে যাঁর কাছে ন্যায়বিচার এবং সে আলোকে পুরস্কার ও শাস্তি পাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে শংকামুক্ত ও নিশ্চিন্ত। অর্থাৎ- কেউ যদি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে বা কারো সম্পদ গ্রাস করে অথবা কারো অধিকার ক্ষুন্ন করে এবং সে যতই প্রভাবশালী বা জুলুমবাজ হোক না কেন, ঈমানদার মাত্রই এ ব্যাপারে নিশ্চিত আশা পোষণ করে যে, এর উপযুক্ত বিচার এবং প্রতিবিধান তিনি অবশ্যই সেদিন মহাশক্তিধর প্রভূর কাছ থেকে লাভ করবেন। অনুরূপভাবে কেউ যদি কাউকে বাঁচিয়ে তোলে বা কারো সম্পদ সংরক্ষণ করে অথবা কারো অধিকার ঠিকঠাক আদায় করে এবং সে জন্য যদি তাকে প্রাপ্য মর্যাদা বা প্রতিদান দেয়া না হয়, তাহলে ঈমানদার মাত্রই এ ব্যাপারে নিশ্চিত আশা পোষণ করে যে, এর উপযুক্ত প্রাপ্য এবং পুরস্কার তিনি অবশ্যই সেদিন মহাশক্তিধর প্রভূর কাছ থেকে লাভ করবেন। তিনি অবশ্যই সেদিন অপরাধিদেরকে তাদের সামনে উত্থিত করবেন এবং তাদের যথোপযুক্ত বিচার করবেন। যারা তাদের সঠিক প্রাপ্য পায়নি কিন্তু তাঁর নামে ধৈর্য ধারণ করেছে, তাদেরকে তিনি সর্বোত্তম পুরস্কারে ভূষিত করবেন। তাঁর শপথকৃত সেই প্রতিফল দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার নাম হল ‘ছবর’। যা হল ‘ঈমানের অর্ধেক’।

তিন.

মহাশক্তিধর ও একমাত্র সুবিচারক মহান প্রভূর প্রতি ঈমান আনার পর ঈমানদার ব্যক্তি এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, যিনি সমগ্র সৃষ্টিকুলের মাঝে প্রভূর সান্নিধ্য ও নৈকট্যপ্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি। যিনি ঈমানদারগণ ও তাদের প্রভূর মাঝে মজবুত সেতুবন্ধন। যিনি প্রভূর পক্ষ থেকে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন, তাদের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করেন। এ মহান রাসূল বা বার্তাবাহক অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে প্রভূর পক্ষ থেকে প্রেরিত সকল বাণী তাদের নিকট পৌঁছে দেন। যে জন্য তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির সাথে তাঁর সম্পর্ক এতই প্রগাঢ় যে, তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে তাদেরকে বিপথগামীতা থেকে টেনে এনে সুপথে পরিচালিত করেন এবং তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের জ্বলন্ত আগুন থেকে বাঁচান। তাদেরকে মহান প্রভূর নির্দেশনার আলোকে জীবন-যাপনের পদ্ধতি হাতে-কলমে শিক্ষা দেন। তিনি অপরাপর সাধু-সন্ন্যাসীর ন্যায় এমন কোন তাত্ত্বিক জীবন-যাপন পদ্ধতি শিক্ষা দেননি, যা অনুসরণ করতে গিয়ে ঈমানদারগণ তাঁর জীবনে অনুরূপ দৃষ্টান্ত খুঁজে পায় না। অর্থাৎ- যা তিনি বলেছেন তা তিনি করেছেন এবং এতে কোন প্রকার বৈপরিত্য দেখা যায় না। তিনি প্রভূর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ এবং তা এ অর্থে যে, ঈমানদারগণ একমাত্র তাঁর মাঝেই ঈমানের পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন খুঁজে পায়। এ মহান রাসূলের সাথে প্রত্যেক ঈমানদারের জীবন ও আত্মা এত গভীরভাবে সম্পৃক্ত যে, জীবনের প্রতি পরতে পরতে তারা তাঁকে উপলব্ধি করে এবং মুহুর্মুহু স্মরণ করে। ঈমানদারদের জন্য তাঁর অন্তহীন ভালোবাসা এবং নজিরবিহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার কারণে মহান প্রভূ তাঁকে এমন নজিরবিহীন নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দান করেছেন যে, তিনিই পারেন কেবল তাদের নাজাত ও মুক্তির বিষয়ে মহান প্রভূর নিকট সুপারিশ করতে। তিনি হলেন ঈমানদারদের শিক্ষক, অভিভাবক এবং উভয়জাহানের ত্রাণকর্তা।

চার.

ঈমান গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে মু’মিন ব্যক্তি এমন এক বৃহত্তর ও সার্বজনীন উম্মাহর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে যায়, যেই উম্মাহ কোন দেশ, মহাদেশ এবং সুনির্দিষ্ট কোন যুগ বা কালের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। যার প্রথম বৈশিষ্ট্য হল- বিশ্বের যে প্রান্তে বা যে অঞ্চলে হোক না কেন, মু’মিন হওয়ার কারণে অন্যরা তার ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল- ঈমান গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মু’মিন ব্যক্তি এই বৃহত্তর উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের কাছ থেকে নিজের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা লাভ করে থাকে। অর্থাৎ- উম্মাহর কারো জন্যই এটি কোনক্রমে বৈধ নয় যে, কেউ তার জীবন-জীবিকা, সহায়-সম্পদ ও ইজ্জতের উপর আঘাত হানবে। বরং উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের উপর এটি অত্যাবশ্যক যে, যে কোন বিপদে-মুসিবতে তারা তাকে সাহায্য করবে এবং তাকে রক্ষা করবে। এই উম্মাহর নাম হল- ‘উম্মতে মুসলিমাহ’ বা মুসলিম উম্মাহ। যার প্রত্যেক সদস্য পরস্পর ভাই ভাই।

পাঁচ.

ঈমান গ্রহণের সাথে সাথে মু’মিন ব্যক্তি এই পৃথিবীর চাইতেও অসংখ্যগুণ বড় এবং অকল্পনীয় নাজ-নিয়ামতে ভরপুর এক মহা মূল্যবান জান্নাতের চিরস্থায়ী মালিক হয়ে যায়। যার দৈর্ঘ ও প্রস্থ অংকে নিরূপণ করা যায় না। এমনকি যদি কেউ ঈমান গ্রহণের পর কোন একটি আমলেরও সুযোগ না পায়, তথাপি তার জন্য শুধুমাত্র ঈমানের বিনিময়ে রয়েছে এমন এক সুসজ্জিত জান্নাত। যার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য সম্পর্কে কেউ না কখনো শুনতে পেরেছে আর কেউ না কখনো কল্পনা করতে পেরেছে! অকল্পনীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর সে জান্নাতে প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তি সবচেয়ে কাঙ্খিত যে দর্শন লাভ করবে তা হল- যে মাওলায়ে আ’লা এবং নিপুন সৃষ্টিকর্তাকে চোখে না দেখেও এতকাল যাবত হৃদয়ের গহীনে বিশ্বাসের যে বাতি প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছিল, সেই মহশক্তিধর এবং নিরংকুশ ও নিরাকার প্রভূর দর্শন লাভ করা। প্রভূ সেই দিন তাঁর প্রতি ঈমান আনায়নকারী প্রত্যেক মু’মিনের এত কাছে থাকবেন যেন তারা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে! এটিই হল তাঁর সেই নৈকট্য অর্জনের আহবান, যা তিনি সমস্ত ইবাদাতের মাধ্যমে করেছেন।

 

Spread the love