বর্তমানে ‘জুলুমময়’ এক বিশ্বে বসবাস করছি আমরা। এক প্রান্তের মানুষ অপর প্রান্তের মানুষকে, এক দেশের মানুষ অপর দেশের মানুষকে, এক ধর্মের মানুষ অপর ধর্মের মানুষকে, এক দলের মানুষ অপর দলের মানুষকে, এক সম্প্রদায়ের মানুষ অপর সম্প্রদায়ের মানুষকে নির্বিচারে অন্যায়-অত্যাচার করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের এ বিশ্বে মানুষ আজ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মানবতা চরমভাবে অপমানিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও লাঞ্চিত। বিশ্বের বিরাট এক শ্রেণির মানুষ আজ ‘জালিম’ এবং জুলমের দোষে দুষ্ট ও অপরাধি। অপরদিকে সহায়-সম্বলহীন অধিকাংশ মানুষ আজ মজলুম। একই গ্রহের  মানুষ হয়েও অধিকার বঞ্চিত এবং বর্বরতার শিকার। ইসলাম সর্বদা জালিমের বিপক্ষে এবং অধিকার বঞ্চিত ও বর্বতার শিকার মজলুম মানুষের পক্ষে কথা বলে। মানবজাতির মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও জালিমের বিপক্ষে মজলুমের দোয়া কবুল করেন।

‘জালিম’ এবং ‘মজলুম’ শব্দদ্বয় আরবী ‘জুলম’ শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ‘জুলম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ- অত্যাচার, সীমালঙ্ঘন, নিষ্পেষণ বা অবিচার ইত্যাদি। আরবি ভাষায় কোনো বস্তুকে তার প্রকৃত স্থলে প্রয়োগ না করে অন্যত্র প্রয়োগ করা বা যথাযথ প্রাপ্য না দিয়ে কম দেয়া বোঝাতে জুলুম শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ইসলামি শরিয়াতের পরিভাষায় ‘ন্যায়নীতি বর্জন করে অন্যায়-অবিচার করাকে ‘জুলম’ বা অত্যাচার বলা হয়।’ মুফাসসিরগণ বলেন, ‘জুলম হল অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা এবং আল্লাহর আইন অমান্য করা।’ কেউ কেউ বলেন, ‘মিথ্যা অভিযোগে কাউকে দোষারোপ করা এবং তার ওপর ভিত্তি করে সাজা প্রদান বড় রকমের জুলম।’ পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে জুলম থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে ‘জালিম’ বা অত্যাচারী সেই ব্যক্তি, যে অন্যকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে। আর ‘মজলুম’ বা অত্যাচারিত সেই ব্যক্তি, যে জালিমের দ্বারা জুলম বা অত্যাচারের শিকার হয়ে থাকে। অতএব যে ব্যক্তি অন্যের সম্পদে হস্তক্ষেপ করে সে জালিম, যে শাসক জনগণের প্রাপ্য আদায় করে না সে জালিম, যে বিচারক তার রায়ে পক্ষপাতিত্ত্ব করে সে জালিম। আর যে অংশীদার অন্য অংশীদারের খেয়ানত করে সে জালিম, যে স্বামী তার স্ত্রীর ওপর অন্যায়-অবিচার করে সে জালিম, যে স্ত্রী তার স্বামীর হকের প্রতি লক্ষ রাখে না এবং সন্তানদের সৎ আচার-ব্যবহার শিক্ষা দেয় না সে-ও জালিম। মোটকথা, এ রকম প্রতিটি ব্যাপার বা কাজ যে-ই করুক না কেন, যার দ্বারা অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন হয়, সে জালিম। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ জালিমের পরিচয় তুলে ধরে ঘোষণা করছেন, ‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সুবিচার করে না তারা জালিম।’ [মায়িহ- ৪৫]। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন, পৃথিবীতে যারা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-এর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করেনা তারা জালিম। [মারিফুল কুরআন]। অন্য আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহর বিধানের সীমারেখা অতিক্রম করে তারা জালিম।’ [বাকারাহ- ২২৯]।

ইসলামে যে কোন ধরনের জুলম যেমন- ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক জুলমকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। হাদিসে কুদসিতে মহানবী সাঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে এরশাদ করেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজের ওপর জুলমকে হারাম করে দিয়েছি আর তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অন্যের ওপর জুলম করো না।’ [সহীহ মুসলিম]।

জুলম একটি মারাত্মক অপরাধ। অতএব যেখানেই হোক, তা প্রকাশ মাত্র এর মূলোৎপাটন করা অপরিহার্য। নতুবা তার ফল সমাজ ও রাষ্ট্র এমনকি বিশ্বের সকল মানুষকে ভোগ করতে হবে। জালিমদের পক্ষ অবলম্বন, তাদের কাজে সন্তুষ্টি জ্ঞাপন এবং তাদেরকে সহযোগিতা করা ইসলামে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। জালিম এবং তার কাজে সহযোগিতা প্রদানকারী একই পরিণতি ভোগ করবে মর্মে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘যারা জালিম তাদের প্রতি তোমরা ঝুঁকে পড়ো না, তাহলে তোমাদেরকেও অগুন স্পর্শ করবে।’ [হুদ-১৩] অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন জালিমদের জন্য কেউ দরদি হবে না, আর না কেউ সুপারিশকারী হবে।’ [হজ্জ-৭৯]।

কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের সর্বত্র যখন জুলমের বিস্তার ঘটে তখন এর ফলস্বরূপ নিকৃষ্ট সব লোক শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ফলে ওই জাতির সাধারণ লোকদেরকে অত্যাচার ভোগ করতে হয় এবং জুলমের স্বাদ আস্বাদন করতে হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেন, ‘এমনিভাবে আমি তাদের মন্দ কৃতকর্মের জন্য জালিমের এক দলকে অন্য দলের ওপর প্রবল করে থাকি।’ [আনআম-১২৯]।

জালিমরা যে সমাজ বা রাষ্ট্রে নেতৃত্ব দেয় সে সমাজ বা রাষ্ট্রের উপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যায়। উপরন্তু সেই সমাজ বা রাষ্ট্র অভিসম্পাতের উপযুক্ত হয়, ইহকাল ও পরকাল ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আল্লাহতায়ালা এ মর্মে ইরশাদ করেন, ‘ঐসব জনপদ যাদের আমি ধ্বংস করেছিলাম তাদের জুলমের দরুন এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমি নির্ধারিত করেছিলাম একটি নির্দিষ্ট ক্ষণ।’ [কাহাফ- ৫৯]।

পবিত্র কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী জালিমদের চূড়ান্ত পরিণতি হলো জাহান্নামের নিকৃষ্টতম আবাসস্থল। যারা অন্যায়ভাবে কোনো মানুষের ওপর জুলম করে, তাদেরকে মহান আল্লাহ পরকালে কঠিন আজাবের সম্মুখীন করবেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘সে দিন জালিমদের সম্পত্তি কোনো কাজে আসবে না। তাদের জন্য রয়েছে অভিশাপ এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।’ [মুমিন-৫২]।

আপাতঃ দৃষ্টিতে জালিমদের জুলমের প্রোপাগান্ডা দেখে মানব মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, মহান আল্লাহ কি তার বান্দাদের এ দুর্দশা অবলোকন করেন না? বস্তুতঃ আল্লাহতায়ালা জালিমদের সব জুলম সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত আছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কখনো মনে করো না যে জালিমরা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত নন। আসলে আল্লাহ তাদেরকে ওই দিনের জন্য অবকাশ দিচ্ছেন, যে দিন তাদের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে এবং তারা মাথা উঁচু করে দৌড়াতে থাকবে।’ [ইব্রাহিমঃ ৪২]। এ সম্পর্কিত একটি হাদিসে হজরত আবু মুসা রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন তিনি তাকে গ্রেফতার করেন তখন আর ছাড়েন না। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন, ‘আর তোমার রব যখন কোনো জালিম জনবসতিকে পাকড়াও করেন, তখন তার পাকড়াও এমনই হয়ে থাকে। তার পাকড়াও বড়ই কঠিন, নির্মম ও পীড়াদায়ক।’ [হুদঃ ১০২], [বুখারি]। জালিমের পরিণতি সম্পর্কে মহানবী সাঃ আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ জমিতে জুলম করল কেয়ামতের দিন সাত তবক পরিমাণ জমিন তার গলায় লটকে দেয়া হবে।’ [বুখারি ও মুসলিম]।

জালিমদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মহানবী সাঃ মুসলমানদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। হাদিস শরীফে এসেছে এক ব্যক্তি মহানবী সাঃ-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! একজন মুসলিমের পরিচয় কি? রাসূলুল্লাহ সাঃ বললেন, ‘যে নিজে জুলম করে না এবং অন্যের জুলমেরও শিকার হয় না।’ [বুখারি]। অপর এক হাদিসে এসেছে মহানবী সাঃ বলেন, ‘জালিম ও মজলুম উভয় অবস্থায় তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি ওই ব্যক্তি মজলুম হয় তবে তো তাকে সাহায্য করা যায়, কিন্তু জালিম হলে সাহায্য করব কিভাবে? তিনি বললেন,তাকে বাধা দাও এবং জুলম থেকে বিরত রাখো, এটাই তার সাহায্য।’ [সহীহ বুখারি ও মুসলিম]।

হাদিস শরিফে মজলুম ব্যক্তির দোয়াকে ভয় করতে বলা হয়েছে। হজরত ইবনে আবাস রাঃ বলেন, নবী করিম সাঃ মুয়াজ ইবনে জাবাল রাঃ-কে ইয়েমেনে পাঠানোর কালে বললেন, ‘হে মুয়াজ! মজলুমের বদদোয়াকে ভয় করো, কেননা তার বদদোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।’ [সহীহ বুখারি]। হজরত আবু হুরায়রা রাঃ বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার অপর ভাইয়ের ইজ্জত-সম্মান বিনষ্ট করে কিংবা কোনো বিষয়ে জুলম করে, সে যেন আজই তার কাছে কৃত জুলমের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয় সেই দিন আসার আগে, যেই দিন তার কোনো অর্থসম্পদ থাকবে না। সেই দিন তার কোনো নেক আমল থাকলে তা থেকে জুলমের দায় পরিমাণ নেক আমল কেটে নেয়া হবে। আর যদি তার কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে সমপরিমাণ পাপ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে।’ [সহীহ বুখারি]।

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে কথা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জুলমের পরিণাম দুনিয়া ও আখেরাতে মোটেও সুখকর নয়। ব্যক্তিগত বা দলিয় স্বার্থোদ্ধারের জন্য অন্যের ওপর জুলমের পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই সবাইকে নিজের উপর এবং অন্যের উপর জুলম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিখ্যাত এক কবির উপদেশ হল- ‘তোমার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কারো ওপর জুলম করো না। কেননা জুলুমের শেষ ফল বড়ই লজ্জাজনক। তুমি তো নিদ্রায় বিভোর থাকো, কিন্তু মজলুম ব্যক্তি বিনিদ্র রজনী যাপন করে তোমার জন্য বদদোয়া করতে থাকে। আর আল্লাহ তো হলেন সদা জাগ্রত।’

 

Spread the love