ইসলামে ‘দান-সাদাকাহ’র ধারণা’ অত্যন্ত ব্যাপক। শুধুমাত্র আর্থিক অনুদানকে দান বিবেচনা করার যে দুর্বল মানসিকতা আমাদের সমাজে বিদ্যমান, ইসলামের ‘দান ধারণা’ মূলত তার চেয়ে অধিক বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। যেমন- ইসলামের দৃষ্টিতে কাউকে শুধু টাকা-পয়সা দেওয়াই দান নয়, বরং কাউকে একটি ভালো পরামর্শ দেওয়া, কারো প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, কারো বোঝা বহন করা, বিপদের সময় পাশে থাকা, সাপোর্ট দেওয়া, সময় দেওয়া, শ্রম দেওয়া ইত্যাদিও উত্তম দানের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে সাদাকাহ মানে শুধু অর্থ-সম্পদ দান করা নয়, বরং কোন মুসলিম ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ করা, তার সাথে সুন্দর আচরণ করা, দুর্ব্যবহার না করা, রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া, রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ না করা, আল্লাহর নামে তাছবীহ পাঠ করা, স্ত্রীকে ভালোবাসা ইত্যাদি উত্তম সাদাকাহ হিসাবে পরিগণিত। কিন্তু হতাশাজনকভাবে এ সকল বিষয় আলোচনায় তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। অথচ জীবনকে ঋদ্ধ করতে হলে দানের যে বৃহৎ এবং সুবিস্তৃত ধারণা ইসলাম পেশ করেছে, তা জানা খুবই জরুরী।

দানকে যদি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিকের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়, তাহলে এটি যেমনি একদিকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি অপরদিকে অধিকাংশ মানুষ যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়, তাদের কি তাহলে দান করার কোন সুযোগ নেই? -এমন একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। অথবা তারা কি তাহলে এমন দুর্ভাগা বনি আদম যাদেরকে দান-সাদাকাহ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে? অথচ কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী সকলকে তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের ইচ্ছানুযায়ী কম-বেশী রিজিক প্রদান করেন। [সূরা আনকাবূত- ৬২]। এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে- না, দান করার মত অর্থ-সম্পদ যদি কারো নাও থাকে তথাপি ইসলাম বলছে- সবাই যার যার সামর্থ অনুযায়ী দান করতে পারে। সবাই পারে অর্থ দাতাদের মত নিজের প্রয়োগযোগ্য অন্যান্য সামর্থ যেমন- মেধা, বুদ্ধি, সময়, শ্রম ইত্যাদি দান করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে।

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় দান বুঝাতে প্রধানতঃ দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। (এক) ‘ইনফাক’ (দুই) ‘সাদাকাহ’। ইনফাক হল- আল্লাহর রাস্তায় কোন কিছু ব্যয় করা। এটি দানের ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ। আর্থিক অনুদান থেকে শুরু করে সময়, শ্রম, জ্ঞান-বুদ্ধি, সৎ কাজ, সৎ উপদেশ, অন্যের উপকারের নিমিত্তে ত্যাগ স্বীকার করা, সেবা-শুশ্র“ষা করা ইত্যাদি যে কোন ভাল কাজ দানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে ‘সাদাকাহ’ অর্থও দান। কোন কোন ক্ষেত্রে যদিও জাকাতকে সাদাকাহ বলা হয়, তবে সাদাকাহ জাকাতের চেয়ে আরো ব্যাপক প্রত্যয়। সাদাকাহ দু’ভাগে বিভক্ত। যথা- (১) আবশ্যিক বা ফরজ সাদাকাহ এবং (২) স্বতঃস্ফূর্ত বা নফল সাদাকাহ। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল- স্বতঃস্ফূর্ত বা নফল সাদাকাহ।

কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোটা বিশ্ববাসীকে সামর্থ অনুসারে দান করার জন্য নিরন্তর উৎসাহ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘হে মু’মিনগণ! তোমাদেরকে কি আমি এমন এক ব্যবসার কথা বলে দেব না যা তোমাদেরকে আখেরাতে কঠিন শাস্তি থেকে নাজাত দিবে? তা হল- তোমরা ঈমান আন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি, আর সংগ্রাম কর আল্লাহর পথে সম্পদ ও জীবন দিয়ে।’’ [সূরা ছফ : ১০]। এই আয়াতে দান সম্পর্কে একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা রয়েছে। এখানে দান হিশাবে সম্পদ এবং জীবনকে পাশাপাশি নিয়ে আসা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরকালীন মুক্তির জন্য সম্পদ এবং জীবন উভয়টিকে আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিতে। যারা সম্পদশালী তারা সম্পদ দান করবে আর যাদের অর্থ-সম্পদ নেই, তারা তাদের জীবন দান করবে। জীবন মানে হল- সময়, শ্রম, কাজ ইত্যাদি। কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘‘দান কর আল্লাহর পথে। নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না। উত্তমরূপে ভাল কাজের আঞ্জাম দাও। এভাবে যারা ভাল কাজে যত্নবান হয়, আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যই ভালবাসেন।’’ [ সূরা বাকারা : ১৯৫ ]। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, ‘‘নম্র কথা বলা এবং ক্ষমা প্রদর্শন করা ঐ দান অপেক্ষা উত্তম, যার পরে কষ্ট দেওয়া হয়। জেনে রাখুন, আল্লাহ সম্পদশালী ও সহিষ্ণু। [ সূরা বাকারা : ২৬৩ ]। পবিত্র কোরআনের এই তিনটি উদ্ধৃতি থেকে বিষয়টি অত্যন্ত পরিস্কার হয়ে যায় যে, যে কোন ভাল কাজ ইসলামে দান হিসেবে পরিগণিত।

দান সম্পর্কে বিস্তারিত এবং খোলাখুলি আলোচনা এসেছে সুন্নাহয় (হাদীস শরীফে)। যেখানে দান সম্পর্কে সুবিস্তৃত ও তাৎপর্যপূর্ণ ধারণা লাভ করা যায়। যেমন- মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক মুসলিমের দান করা আবশ্যক। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, যদি দান করার মত টাকা-পয়সা না থাকে তাহলে সে কেমন করে দান করবে? নবী (সাঃ) বলেন, যার টাকা-পয়সা নেই সে যেন নিজ হাতে পরিশ্রম করে উপার্জন করে। এতে সে নিজে উপকৃত হবে এবং তা থেকে দান-খয়রাত করবে। সাহাবীগণ পুনরায় বললেন, যদি কেউ পরিশ্রম করতে না পারে তবে সে কেমন করে দান করবে ? রাসূল (সাঃ) বললেন, যদি কেউ পরিশ্রম করতে না পারে, সে ব্যক্তি কোন লোকের আবশ্যকীয় কাজে সাহায্য করবে। তা তার জন্য দান হিসেবে গণ্য হবে। সাহাবীগণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, যদি কেউ তাও করতে না পারে, সে কিভাবে দান করবে? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, যদি কেউ হাতের কাজেও সাহায্য করতে না পারে, তবে সে কিছু ভাল কথা বলে লোকের উপকার ও সাহায্য করবে। তা তার জন্য দান বলে পরিগণিত হবে। সাহাবীগণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাও যদি না পারে তাহলে কিভাবে দান করবে? রাসূল (সাঃ) বলেন, সে অন্ততঃ এতটুকু করবে যে, সে কোন কথা দ্বারা বা কোন কাজ দ্বারা বা কোন আচার-ব্যবহারের দ্বারা কাউকে কষ্ট দেবে না এবং কারো কোন ক্ষতি করবে না। তাহলে তা তার জন্য দান হিসেবে গরিগণিত হবে।’’ [ সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুল আদাব, অধ্যায়-৩৩ ]।

অপর হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘‘দুজন লোকের মাঝে ন্যায় ও নিরপেক্ষভাবে বিচার করে দেওয়া দান হিসেবে পরিগণিত হবে। যাতায়াতের পথে কোন লোকের বোঝা উঠাবার সময় সাহায্য করাও দান হিসেবে গণ্য হবে। কোন লোককে একটি ভাল কথা বলাও দান হিসেবে গণ্য হবে। নামাজের জন্য মসজিদে যেতে যে কয়টি কদম উঠাতে হয় তার প্রতিটি কদম দান হিসেবে গণ্য হবে। রাস্তা থেকে লোকের কষ্টদায়ক যে কোন জিনিস সরিয়ে দেয়াও দান হিসেবে গণ্য হবে।’ [ সহীহ মুসলিম, হাদীস-৮৪ ]।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেন, ‘‘কোন মুসলিম ভাইকে দেখে তার সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা যাতে সে তোমাকে দেখে আনন্দ বোধ করে, তাও একটি দান তুল্য। কোন লোককে ভাল কাজ করতে আদেশ দেওয়া এবং মন্দ কাজ করতে নিষেধ করাও দান। কোন পথিক পথ ভুলে গেলে তাকে পথ দেখিয়ে দেয়াও একটি দান। কেউ যদি চোখে কম দেখে এবং তুমি তাকে সাহায্য কর তাও তোমার জন্য দান হিসেবে গণ্য হবে। এমনকি কেউ যদি অন্যকে তার পাত্রে পানি তুলতে সাহায্য করে, তাও ঐ ব্যক্তির জন্য দান হিসেবে গণ্য হবে।’’ [ সুনানুত তিরমিযী, বাব-৩৬ ]।

মহানবী (সাঃ) বলেন, কোন মুসলিম কোন মুসলিমকে তার কাপড়ের অভাবের সময় কাপড় দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের কাপড় উপহার দিবেন। কোন মুসলিম কোন মুসলিমকে ক্ষুধার সময় খাবার দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফল দান করবেন। আর যে মুসলিম অন্য মুসলিমকে তার পিপাসার সময় পানি পান করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে সিলমোহর লাগোনো ‘শারাবান তহুর’ পান করাবেন। [ সুনানু আবী দাঊদ, হাদীস-১৬৮১ ]।

দান সম্পর্কে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে সহীহ মুসলিম শরীফে। হজরত আবু জার (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম (সাঃ) এর কিছু সংখ্যক সাহাবী তাঁর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! ধন-সম্পদের মালিকেরা তো সব সাওয়াব লুফে নিচ্ছে। কেননা আমরা যেভাবে নামাজ পড়ি তারাও পড়ে। আমরা যেভাবে রোজা রাখি তারাও রাখে। কিন্তু তারা তাদের অতিরিক্ত সম্পদ দান করে সাওয়াব লাভ করছে, অথচ আমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। অতঃপর নবী করীম (সাঃ) বলেন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এমন অনেক কিছু দেননি! যা দান করে তোমরা সাওয়াব পেতে পার? আর তা হল- প্রতিবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা এক একটি দান। প্রতিবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলা এক একটি দান। প্রতিবার ‘আল হামদুলিল্লাহ’ বলা এক একটি দান। প্রতিবার ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলা এক একটি দান। প্রত্যেক ভাল কাজের আদেশ দেয়া ও উপদেশ দেয়া একটি দান এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা ও বাধা দেয়া একটি দান। এমনকি তোমাদের শরীরের অংশেও দান রয়েছে। অর্থাৎ- আপন স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়াও একটি দান। সাহাবীগণ বললেন, আমাদের কেউ তার কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবে আর এতেও তার সাওয়াব হবে? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা বল দেখি, যদি তোমাদের কেউ তা হারাম কাজে (ব্যভিচার) ব্যবহার করত তাহলে কি তার গুনাহ হত না ? তাই অনুরূপভাবে যখন সে তা হলালভাবে ব্যবহার করবে তাতে তার সাওয়াব হবে।’ [সহীহ মুসলিম-২২০০]।

ইসলামে দান ধারণার মূল কথাটি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এক বাক্যে বলে দিয়েছেন। হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, মহানবী (সাঃ) বলেছেন- ‘‘প্রতিটি ভাল কাজই দান’’। [্আল-আদাবুল মুফরাদ -২২৪ ]।

 

Spread the love