মেহমানদারিতা সবার প্রিয়। মেহমানের সাথে যারা আন্তরিকভাবে মিশে তাদেরকে সবাই পছন্দ করে এবং তারা সবার আপন হয়ে যায়। কিন্তু মেহমান দেখলে যাদের মুখটা মলিন হয়ে যায় এবং যারা মেহমানের সাথে ভাল ব্যবহার করে না, তাদেরকে কেউ পছন্দ করে না। এমন অনেক বিত্তশালী মানুষ আছে যারা ভালোভাবে মেহমানদারিতা করার ক্ষমতা রাখে কিন্তু তারা মেহমানের সাথে খারাপ আচরণ করে বলে তাদের বাসা-বাড়িতে কেউ যায় না। মানুষ সাধারণত সেখানেই যায়, যার কাছে যেতে, থাকতে ও খেতে সে পছন্দ করে। দেখা যায়, উন্নত মানের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও অনেকের বাসা বাড়িতে সবসময় মেহমান ভরপুর থাকে। এর কারণ হল ঐ সব বাসার লোকজন মেহমান আসলে বিরক্ত হয় না এবং তারা মেহমানদেরকে আন্তরিকভাবে বরণ করে নেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মেহমানরা হল আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ, তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা সুন্নাত এবং তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হারাম।
কষ্ট হলেও যারা মেহমানদারি করে এবং মেহমানের সাথে সুন্দর ব্যবহার করে, তারা ভালো মনের মানুষ। ইসলামের দৃষ্টিতে তাদেরকে মু’মিন মুত্তাকী হিসাবে অভিহিত করা যায়। যারা অভাব-অনটনের মাঝেও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা. এর সন্তুষ্টির কথা ভেবে মেহমানদারিতা করতে কার্পণ্য করে না, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখেরাতে রয়েছে কল্যাণ ও বরকতের ঘোষণা।
সর্বক্ষেত্রে মেহমানদারিতার রয়েছে একটা বিশেষ প্রভাব। যারা বেশি বেশি মেহমানদারি করে তারা সহজে নেতৃত্ব লাভ করে, বন্ধুমহলে সামনের সারিতে থাকে এবং যে কোথাও সবার মধ্যমনিতে অবস্থান করে। ইমাম আবূ হানিফা রা. তাঁর প্রিয় ছাত্র ইমাম আবূ ইউসূফ রা. কে এক চিঠিতে লিখেন- “তুমি যখন তোমার বন্ধুদের সাথে থাক তখন তাদেরকে সাধ্যানুযায়ী আপ্যায়ন করতে চেষ্টা করবে এবং সম্ভব হলে তাদের যাতায়াত খরচ বহন করবে। এতে তুমি তাদের নেতা হতে পারবে।” তাছাড়া মেহমানদারিতার রয়েছে পারিবারিক এবং সামাজিক গুরুত্ব। গ্রামেগঞ্জে আজও বিভিন্ন পরিবারে মেহমানদারিতাকে ঐতিহ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের এক মরহুম চাচা বলতেন- ‘যে ঘরের লোকজন বেশি বেশি মেহমানদারি করে সে ঘরের মেয়েদের দ্রুত বিয়ে হয়ে যায়।’
মেহমানদারিতায় আরবদের বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। ইতিহাসবিদগণ বলেন- বর্বর যুগে আরবদের মাঝে হাতেগোনা যে কয়টি ভালো গুণের সন্ধান পাওয়া যায়, তন্মধ্যে একটি হল মেহমানদারিতা। ইতিহাস থেকে জানা যায়- একবার কোন এক আরবীয়ের বাসায় তার পিতার হত্যাকারী ভুলক্রমে এসে রাতে মেহমান হয়ে যায়! আলোচনার এক পর্যায়ে ঐ মেহমান যে তারই পিতার হত্যাকারী তা সুস্পষ্ট হয়ে যায়। অথচ দীর্ঘদিন থেকে ঐ আরবীয় তার পিতার এই হত্যাকারীকেই পথেপ্রান্তরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। নিজ পিতার হত্যাকারীকে হাতের কাছে পাওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মেহমান হওয়ার কারণে তারসাথে কোনরূপ দুর্ব্যবহার না করে তাকে বরং একটি ঘোড়ায় চড়িয়ে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ঐ আরবীয়। যাতে লোকটি প্রাণে বেঁচে যায়।
মেহমানদারিতায় আরবদের অতি উচ্চাভিলাষী এবং নৃশংস মানসিকতারও পরিচয় পাওয়া যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা অল্প সংখ্যক মেহমানের জন্য বিরাট একটি উট জবাই করে দিতো। যা ছিল তাদের অপচয়ের নমুনা। অপরদিকে তাদের কেউ কেউ মেহমানকে খুশি করার জন্য তার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা জীবন্ত উটের শরীর থেকে গোশতের টুকরো কেটে আনতো। এতে কেটে নেওয়া অংশ দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে হতে উটটি অবশেষে মৃত্যুবরণ করতো। যা ছিল আরবদের নৃশংসতার নমুনা। অথচ ইসলামে এমন অপব্যয় এবং নৃশংসতা হারাম।
মেহমানদারির ক্ষেত্রে আরবদের অভিজাত শ্রেণীর এমন বাড়াবাড়ি এবং নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিপরীতে সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও কী দারুণভাবে মেহমানদারি করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহাবীগণ। যেমন- ইসলামি যুগে কোন এক গরীব সাহাবীর ঘরে মেহমান আসলে তিনি মেহমানকে খেতে দেন এবং তৎক্ষনাৎ বাতির আলো কমিয়ে দেন। মেহমান আলো কমিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘তিনি এবং তার স্ত্রী খাচ্ছেন। কিন্তু স্ত্রী পর্দা করেন বলে আলো কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ অথচ প্রকৃত অবস্থা ছিল এই যে, ঐ গরীব সাহাবীর ঘরে শুধুমাত্র একজনের খাবারই মজুদ ছিল যা তারা মেহমানের সামনে দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা. এর ঐ সাহাবী এমন এক কৌশল অবলম্বন করেন যাতে মেহমান তা বুঝতে না পারে এবং মনোক্ষুন্ন না হয়।
মেহমানদারিতার প্রতি মুসলমানদেরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। কেননা মেহমান হয়- প্রথমতঃ আত্মীয়-স্বজন, না হয় পাড়া-প্রতিবেশি, না হয় বন্ধু-বান্ধব, না হয় চেনা-জানা পরিচিত কেউ। বাড়ির মালিকের উপর যাদের রয়েছে অধিকার এবং মেহমানের প্রতি রয়েছে কর্তব্য। প্রকৃতপক্ষে এঁদের সম্মিলনেই হচ্ছে মুসলিম সমাজ। যে সমাজ একে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধ এবং আধ্যাত্মিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিনির্মানের মুখাপেক্ষী। এজন্য ইসলামে মেহমানকে অপমান করা এবং মেহমানের সাথে কোনরূপ খারাপ ব্যবহার করা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। অপরপক্ষে যারা মেহমানের সাথে ভালো ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কষ্ট দিবে না, পরকালীন জীবনে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় কর এবং অভুক্তকে খাবার দাও। আর এর বিনিময়ে প্রশান্তিময় জান্নাত লাভ করো।” তিনি আরও বলেছেন, “তোমাদের মাঝে যার উত্তম জীবনোপকরণ (রিজিক) লাভ করতে চায়, তারা যেন মেহমানের সাথে উত্তম ব্যবহার করে।” এছাড়া অন্যান্য সহীহ বর্ণনায় এসেছে- ‘মেহমানের সাথে ভালো ব্যবহার করলে আয়ু বাড়ে এবং অসুস্থতা ও দুর্ঘটনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করা যায়।’
[বি. দ্র.- কোন কোন আলেম এ মর্মে মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, মেহমানকে খুশি করার জন্য বিভিন্ন প্রকার আইটেমের খাবার প্রস্তুত করলে, যেগুলো সব হয়তো খাওয়া সম্ভবপর নয়, তথাপি তা অপচয় হিসাবে সাব্যস্ত হবে না। এখানে মেহমানকে খুশি করার নিয়্যাত বেশি গুরুত্ব পাবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, কোন ক্ষেত্রেই ইসলাম বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না।]