যুগ যুগ ধরে যে সমস্যাটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতিকে দারুভাবে বাধাগ্রস্ত করছে তা হল- অভ্যন্তরিণ মতপার্থক্য এবং তা থেকে উদ্ভূত ফাসাদ। প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী ‘আদাবুল ইখতিলাফি ফিল ইসলাম’ গ্রন্থে একে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় রোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন- ‘কী আরব, কী অনারব -বিশ্বের সর্বত্র এখন এ রোগের ছড়াছড়ি।’ প্রকৃতই এ রোগে আমরাও পুরো জাতি অত্যন্ত নিদারুনভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি! এ সমস্যা আমাদেরকে ক্রমাগতভাবে নাকাল করে চলেছে এবং প্রত্যেক মুসলিমের মন ও মানসকে দারুনভাবে আঘাত করে চলেছে।
মতপার্থক্য মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এমনকি তা উম্মাহর অভ্যন্তরিণ বিভাজনের ক্ষেত্রে এতই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে যে, এজন্য শত্রুদেরকে কোন বুলেট খরচ করতে হয় না। মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করতে উদ্যত হয়ে যায়। এটা হল উম্মাহ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. এর সেই আশংকা যা বর্তমানে বাস্তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এ সমুন্নত জাতির সামনে পড়ে রয়েছে সকল বিষয়ে ঐক্যের একমাত্র ভিত্তি আল্লাহ পাকের কালাম পবিত্র কোরআন এবং রাসূলুল্লাহ সা.-এর রেখে যাওয়া সুন্নাহ। কে আছে এমন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. এর সামনে মতভেদে লিপ্ত হতে পারে এবং ইসলামের নামে সমাজে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে পারে?
মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিদ্যমান বিভিন্ন ফিরকাহ্ এবং দাওয়াতি গ্রুপগুলোকে দমন করতে ইসলাম বিরোধি শক্তি সর্বদা অভ্যন্তরিণ মতপার্থক্যকে প্রধান হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগায় এবং এখনো সে চেষ্টা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অব্যাহত আছে। বাস্তবে যে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায় তা হল- বিভিন্ন ইস্যুতে ইসলামী গ্রুপগুলোর মাঝে অত্যন্ত সুকৌশলে মতপার্থক্য উসকে দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে টনিকের মত তা অতি দ্রুত কাজ করে এবং মুহূর্তের মধ্যে গ্রুপগুলো একে অন্যের কুৎসা রটনা করতে আরম্ভ করে ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়। তারা প্রকৃত শত্রুদের কথা বেমালুম ভুলে যায়। অথচ ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (আল-ইমরান,১০৩)
বিভিন্ন বিষয়ে উম্মাহর মাঝে যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তা মৌলিক বা গুরুতর কোন মতপার্থক্য নয়। তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত এবং ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান তথা ফরজ-ওয়াজিব সম্পর্কে মুসলমানদের মাঝে মতপার্থক্য নেই। কতিপয় মতপার্থক্য শাখা-প্রশাখাগত ফিক্হী মাসআলা-মাসাইল সংক্রান্ত বিষয়ে এবং কতিপয় হল আক্বীদাহগত সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম বিষয়ে। এ সকল মতপার্থক্যের অন্যতম কারণ হল- ইমামগণের সময়কাল, উপায়-উপকরণ, পরিপ্রেক্ষিত এবং জ্ঞান ও উপলব্ধির তারতম্য। ইসলামী জ্ঞানের জগতে যাঁরা মুজতাহিদ নামে পরিচিত। যাঁরা যুগ ও চাহিদার আলোকে মানুষের জন্য কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে এবং শরীয়াহর উদ্দেশ্যসমূহের আলোকে মাসআলা ইস্তিম্বাত (রায় উদঘাটন) করে থাকেন।
মতপার্থক্যের আধিক্যতার যুগে যে বিষয়ের প্রতি সকলের বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন তা হল- উম্মাহর প্রতিটি ফিরকাহ এবং দাওয়াতি গ্রুপগুলোর কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক বজায় রাখা ফরজ। অপরদিকে বিভেদ সৃষ্টি করা বা বিভেদ সৃষ্টি হয় এমন কোন কার্যক্রমে জড়িত হওয়া কবিরা গুনাহ । এ লক্ষ্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি ও সমালোচনার মুখ বন্ধ করা (হিফজুল লিসান) এবং গ্রহণযোগ্য মুরাব্বি (রাহ্বার) তৈরি করা। যিনি বা যারা বিশ্বস্ততার সাথে মতপার্থক্যজনিত অনৈক্য দূরীকরণে ভূমিকা পালন করবেন এবং ঐক্যের কেন্দ্রে অবস্থান করবেন।
বর্তমানে মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়াবলি সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে মাদরাসা ও মারকাজের গণ্ডি ছেড়ে আম-জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ার ফলে যে আলোচনা-সমালোচনা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে অসহিষ্ণুতা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে, সে জন্য সকল মহলকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া উচিৎ। বিশেষকরে যারা আলেম নয় তাদেরকে আলেমদের বিষয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আলেমদের দায়িত্ব হল, সাধারণ মানুষ যারা ইসলামী জ্ঞানের জগতে মতপার্থক্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তার কার্যকারণ সম্পর্কে অবগত নয়, তাদেরকে ঈমান ও আক্বীদাহর পাশাপাশি এ বিষয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া। সাথে সাথে মানুষকে মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়াবলি থেকে কোরআন ও সুন্নাহর অধিকতর কাছাকাছি মতসমূহ পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত না হয়। নতুবা দ্বীনি দাওয়াতের ময়দানে গুরুতর বিশৃঙ্খলা আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশংকা রয়েছে।
সাধারণ মুসলিমগণ যাতে মতপার্থক্যের ফিতনায় নিপতিত না হয়, সেজন্য মানুষের সামনে এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা যে, জ্ঞান ও উপলব্ধি ক্ষমতা যেহেতু সবার সমান নয় এবং নিয়্যাহ যেহেতু সবার এক নয়, সেহেতু যে কোন বিষয়ে মতপার্থক্য স্বাভাবিক ব্যাপার। এবং এটি খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যে, মতপার্থক্যের মূল কারণ এবং এর পরিণাম সম্পর্কে জেনেও যারা প্রতিনিয়ত মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ের পেছনে লেগে থাকে এবং এর বীজ সমাজের মধ্যে রোপন করতে চায়, তাদের জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্য সৎ নয়। যেমন, ইমাম আশ্-শাওকানী (রহ.) তাঁর ‘আল-আদাবুত ত্বলাব ওয়া মুনতাহাল আদাব’ গ্রন্থে এ প্রকার জ্ঞান চর্চাকারীদের সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, “এরা ইসলামী জ্ঞানের জগতে সেই শ্রেণী -জ্ঞানার্জনের বিষয়ে যাদের নিয়্যাতে ত্রুটি রয়েছে।”
একটি বিষয় সকলের মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইসলামী জ্ঞানের প্রতিটি শাখা প্রতিনিয়ত গবেষণা ও সমৃদ্ধির মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলে। যুগের চাহিদার আলোকে জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে নিত্য-নতুন ধারণা ও পন্থার উদ্ভব হয়। পুরাতন মত নতুনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে আরো শক্তিশালী হয়, নতুবা তা দুর্বল প্রমাণিত হওয়ার মধ্যদিয়ে বাতিল হয়ে যায় এবং অধিকতর শক্তিশালী নতুন মত প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের প্রতিটি মতামত ও ব্যাখ্যা এ নিয়মে এতকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এমনিভাবেই অগ্রসর হতে থাকবে। জ্ঞানের জগতে ইসলামের অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম কারণ এটি।
ইসলামী জ্ঞানের জগতে মতপার্থক্যের আরেকটি মৌলিক কারণ হল- মানুষের নিত্যনতুন সমস্যা এবং পরিবর্তিত যুগ ও পরিপ্রেক্ষিত। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন রায় প্রদানের দৃষ্টান্ত স্বয়ং রাসূলে কারীম সা. এর যুগ থেকে পরিলক্ষিত হয়। রাসূলুল্লাহ সা. একই প্রশ্নের জবাবে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন রায় প্রদান করেছেন, যার প্রমাণ অসংখ্য হাদীসে রয়েছে। মহান ইমাম শাফিয়ী (রহ.) একই মাসআলার রায় ইরাকে যা দিয়েছেন, মিশরে গিয়ে তিনি তা পরিবর্তন করেছেন। ইসলামি জ্ঞানের জগতে এসব ঘটে থাকে কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলিল-আদিল্লাহর ভিত্তিতে এবং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নতুন নতুন প্রেক্ষাপটের কারণে।
কাজেই এ কথা খুবই পরিস্কার যে- ইসলামী জ্ঞানের জগতে মতপার্থক্য কোন নিন্দনীয় বিষয় নয়, যদি তা ইজতিহাদের শর্তসমূহ ও আদব মেনে করা হয়। মতপার্থক্য ইসলামী জ্ঞানের জগতে এমন এক স্তর, যা বিকাশ ও চর্চার মধ্যদিয়ে দ্বীনের ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অর্জনের পথ প্রশস্ত হয়। কাজেই এই প্রকার জ্ঞানের সাথে বরং বেশি বেশি পরিচিত হওয়া এবং অভ্যস্ত হওয়া এখন সময়ের দাবি।
(লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন…)