‘তাকওয়া’ বহুল প্রচলিত একটি ইসলামী পরিভাষা। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় এ সম্পর্কিত ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে তাকওয়ার পরিচয় ও গুণ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে এবং এ সম্পর্কে নানাপ্রকার বিভ্রান্তির নিরসন করা হয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী দাড়ি, টুপি, আলখাল্লা বা লম্বা জামা পরিধান করা, দরবেশী বা বৈরাগী জীবন যাপন করা ইত্যাদিকে যে তাকওয়া মনে করা হয়; কোরআনে তা স্পষ্ট ভাষায় নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত মুত্তাকীদের পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে,

لَیۡسَ الۡبِرَّ اَنۡ تُوَلُّوۡا وُجُوۡهَکُمۡ قِبَلَ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ وَ لٰکِنَّ الۡبِرَّ مَنۡ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ وَ الۡکِتٰبِ وَ النَّبِیّٖنَ ۚ وَ اٰتَی الۡمَالَ عَلٰی حُبِّهٖ ذَوِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنَ وَ ابۡنَ السَّبِیۡلِ ۙ وَ السَّآئِلِیۡنَ وَ فِی الرِّقَابِ ۚ وَ اَقَامَ الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَی الزَّکٰوۃَ ۚ وَ الۡمُوۡفُوۡنَ بِعَهۡدِهِمۡ اِذَا عٰهَدُوۡا ۚ وَ الصّٰبِرِیۡنَ فِی الۡبَاۡسَآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ حِیۡنَ الۡبَاۡسِ ؕ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ

অর্থঃ তোমরা নিজেদের মুখসমূহ পূর্ব দিকে ফিরাও কিংবা পশ্চিম দিকে ফিরাও -এতে কোন কল্যাণ নেই বরং কল্যাণ নিহিত আছে, আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ ও নাবীগণের প্রতি ঈমান আনায়নে এবং আল্লাহর প্রতি ভালবাসার স্বাক্ষরস্বরূপ ধন-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন, মুসাফির ও যাচ্ঞাকারীদের এবং দাসত্বজীবন হতে নিস্কৃতি দিতে দান করায় এবং নামায কায়েমে ও যাকাত আদায়ে, ওয়াদা পূর্ণ করায় এবং অভাবে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংকটে ধৈর্য ধারণ করায় -এ লোকেরাই সত্যপরায়ণ আর এ লোকেরাই মুত্তাকী। [সূরা বাকারা : ১৭৭]

পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে তাকওয়া তথা মুত্তাকীদের স্পষ্ট পরিচয় ও গুণাবলীর কথা তুলে ধরা হয়েছে। যার সারসংক্ষেপ হল,

১. মুত্তাকীরা ঈমানদার হবে।

২. ইসলামের স্তম্ভসমূহ সঠিকভাবে পালন করবে।

৩. জনকল্যাণমূল কাজ করবে।

সুতরাং এটি খুবই পরিস্কার যে, বাহ্যিক পোশাক-আশাক, সীরাত-সুরত, হুজুরী বা দরবেশিকতায় তাকওয়া নিহীত নেই। বরং তাকওয়া নিহীত আছে সকল প্রকার লৌকিকতা পরিহার করে প্রকৃত ঈমানদার হওয়া এবং ব্যবহারিক জীবনে দ্বীন অনুসরণ করে চলায়।

 

পবিত্র কোরআনের একটি মৌলিক পরিভাষা হওয়া সত্ত্বেও এবং এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাকওয়া বলতে অধিকাংশ মুসলিম এখনো হুজুরী বা বাহ্যিক সুরতকেই বুঝে থাকে। ফলে তারা প্রথমত সমাজে ঐসকল লোকদেরকে মুত্তাকী মনে করে, যারা লম্বা জুব্বাধারী এবং মানুষের দান-অনুদান দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। সামাজিকভাবে স্বীকৃত এ সকল মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য হল, কাজ-কর্ম না করে সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকা এবং মেহনত না করে মানুষের দ্বারেদ্বারে ঘুরে বেড়ানো ও দান-সদকা গ্রহন করা। অথচ যারা শুধু দান গ্রহন করে এবং কাজ-কর্ম না করে শুয়ে-বসে থাকে -কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী এ সকল লোক মোটেও মুত্তাকী নয়!

 

মুসলিমদের জন্য অবধারিত একটি গুণ হিসাবে পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে তাকওয়া অর্জনের কথা বলা হলেও ইসলামের তৃতীয় ভিত্তি সিয়াম ফরজ করার প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে তাকওয়ার কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ

অর্থঃ হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। [সূরা বাকারা : ১৮৩]

এই আয়াত আমাদেরকে এই কথা বলে যে, ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ সিয়াম ফরজ করা হয়েছে শুধুমাত্র তাকওয়া অর্জন করার উদ্দেশ্যে। এতদ্ব্যতীত ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা বৈধ নয়!

 

মুসলিমগণ রমাদানের পূর্ণাঙ্গ একটি মাস সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সিয়াম পালন করে। সিয়ামের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে, যা বিশেজ্ঞরা নানাভাবে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু তাকওয়া অর্জনের যে মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম উম্মাহর উপর সিয়াম ফরজ করেছেন, তা অর্জন করা রমাদান মাসে সবার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞানের বিষয় হওয়া উচিৎ। নতুবা আক্ষরিক অর্থে এ থেকে উপকার লাভ করার তেমন কিছু নেই।

 

সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমের কাছে তাকওয়া কি এবং এর বৈশিষ্ট্য কি তা পরিস্কার নয়। কেউ কেউ তাকওয়া বলতে সমাজে দৃশ্যমান বুজুর্গিকে বুঝে থাকে; যা একটু আগে আমরা আলোচনা করেছি। এ ধরনের তথাকথিত তাকওয়ার সাথে ইসলামের কোনপ্রকার সম্পর্ক নেই এবং ইসলাম তা গ্রাহ্য করে না। বরং তাকওয়া হল, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত এমন সব গুণ অর্জনের নাম, যেসব গুণ অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। ফলে তাকওয়ার শরীয়াহ সম্মত একটি স্পষ্ট রূপরেখা রয়েছে এবং তা দু’টি ‘উসূল’ বা মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যে মূলনীতি দ্বয় অনুসরণ করে মুসলিমগণ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন।

 

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে আমরা তাকওয়ার যে দু’টি উসূল বা মূলনীতি খুঁজে পাই তা হল-
১. হারাম বর্জন করা।
২. হালাল গ্রহন করা।

পবিত্র কোরআনকে আমরা ‘কিতাবুত তাকওয়া’ বা তাকওয়ার গ্রন্থ বলে অভিহীত করি। কেননা এ গ্রন্থের শুরুতে বলা হয়েছে,

ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡهِ ۚۛ هُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ

অর্থঃ এটি নির্ভুল এক গ্রন্থ; মুত্তাকিদের জন্য পথনির্দেশনা। [সূরা বাকারা : ২]

এই আয়াতে পবিত্র কোরআনকে সন্দেহাতীতভাবে মুত্তাকীদের জন্য ‘হিদায়াহ’ বা পথনির্দেশিকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। হিদায়াহ হল, যাতে হালাল ও হারাম সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়। আর এর বিপরীত হল ‘দলালাহ’ বা পথভ্রষ্টতা। যাতে হালাল ও হারামের মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করা হয় না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

قَدۡ ضَلُّوۡا وَ مَا کَانُوۡا مُهۡتَدِیۡنَ

অর্থঃ তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং তারা কস্মিনকালেও হিদায়াত লাভ করবে না। [সূরা আনআম : ১৪০]

হালাল ও হারামকে তাকওয়ার মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُحَرِّمُوۡا طَیِّبٰتِ مَاۤ اَحَلَّ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَعۡتَدُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡمُعۡتَدِیۡنَ. وَ کُلُوۡا مِمَّا رَزَقَکُمُ اللّٰهُ حَلٰلًا طَیِّبًا ۪ وَّ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡۤ اَنۡتُمۡ بِهٖ مُؤۡمِنُوۡنَ

অর্থঃ হে মুমিনগণ, আল্লাহ যে সব পবিত্র বস্তু তোমাদের জন্য হালাল করেছেন, তোমরা তা হারাম করো না এবং তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।

আর আহার কর আল্লাহ যা তোমাদের রিয্ক হিসেবে দিয়েছেন তা থেকে হালাল, পবিত্র বস্তু। আর তাকওয়া অবলম্বন কর আল্লাহর যার প্রতি তোমরা মুমিন। [সূরা মায়িদা : ৮৭,৮৮]

রাসূলুল্লাহ সা.কে সংশ্লিষ্ট করে হালাল ও হারাম সম্পর্কে সতর্ক করে বলা হয়েছে,

وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ ٭ وَ مَا نَهٰىکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ

অর্থঃ রাসূল তোমাদের যা প্রদান করেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর। [সূরা হাশর : ৭]

কাজেই এটি পরিস্কার যে, তাকওয়ার মূলনীতি হল দু’টি। যথা- ১. হালাল গ্রহন এবং ২. হারাম বর্জন। যা উল্লিখিত আয়াতসহ কোরআনের অসংখ্য আয়াতে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে।

 

সকল অভিধান মতে, তাকওয়া শব্দের অর্থ হল, বেঁচে থাকা বা বিরত থাকা। পরিভাষায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. কতৃক নিষিদ্ধ (হারাম) কাজ থেকে বেঁচে থাকা এবং নির্দেশিত (হালাল) কাজ করার নাম হল তাকওয়া।

 

তাকওয়ার পরিচয় সম্পর্কে-

◾হজরত আলী রা. বলেন, তাকওয়া হল, আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলা। [বুস্তানুল আরেফীন]

◾ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, তাকওয়া হল, আল্লাহর হুকুম মেনে চলা এবং তাঁর অবাধ্য না হওয়া। [কুরতুবী]

◾উমর বিন আব্দুল আজিজ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাকওয়া হল, আল্লাহর আদেশকৃত কাজ করা এবং নিষেধকৃত কাজ পরিত্যাগ করা।

◾হজরত উবাই বিন কাব বলেন, তাকওয়া হল, কাঁটাযুক্ত বাগানের মধ্যদিয়ে এমনভাবে চলা; যাতে শরীরে কাঁটাবিদ্ধ না হয়। অর্থাৎ- হারাম দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। [তাফসীরে ইবনে কাসির]

তাকওয়া সম্পর্কে পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ ও মুজতাহিদদের বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু দু’টি। যথা- ১. হারাম বর্জন করা এবং ২. হালাল গ্রহন করা। ফলে আমরা এ দু’টিকে তাকওয়ার মূলনীতি হিসেবে গ্রহন করেছি।

 

 

Spread the love