পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতের উপর সিয়াম ফরজ ছিলো এবং সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর উম্মতের উপরও সিয়াম ফরজ করা হয়েছে।পূর্ববর্তী সকল যুগে ফরজকৃত সিয়ামের ধরণ সম্পর্কে মুফাসসিরগণ বিভিন্ন তাফসিরে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এটি এমন এক কালোত্তীর্ণ ইবাদাত; যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমগ্র মানব জাতির উপর সব যুগেই আবশ্যক করেছেন। ফলে মানুষের জীবনে সিয়ামের কার্যকারিতা ও প্রভাবকে সামনে রেখে এটিকে ইসলামের তৃতীয় ভিত্তি হিশাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

 

ইসলামের প্রধান লক্ষ্য হল মানুষের জীবনকে শান্তিপূর্ণ করা। এর প্রতিটি বিধি-বিধান এই লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে প্রণীত হয়েছে এবং এই লক্ষ্যের দিকে সর্বদা পরিচালিত। বিশেষকরে ইসলামের পঞ্চভিত্তি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী জীবন গঠনে এমন পথনির্দেশনা দান করে; কোন মুসলিম যদি তা পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে চলে, তাহলে তার জন্য শান্তি অবধারিত। আবার এটিও স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন যে, মুসলিম হয়েও যারা অশান্তির দাবানলে পুড়ছে, তারা আসলে সঠিকভাবে ইসলাম মানছে না!

 

একটি বাস্তববাদী ও বিজ্ঞানসম্মত দ্বীন হিশাবে ইসলামের প্রতিটি স্তম্ভের সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। যেমন, নামাজের লক্ষ্য হল উত্তম চরিত্র গঠন করা, সিয়ামের লক্ষ্য হল তাকওয়া সৃষ্টি করা, যাকাতের লক্ষ্য হল ধন ও মনকে পবিত্র করা এবং হজ্জের লক্ষ্য হল মুসলিম মিল্লাতকে ঐক্যবদ্ধ করা। এ সকল লক্ষ্য পূরণের মধ্যদিয়ে মুসলিমগণ মূলত তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’র দিকে ধাবিত হয় এবং এটিই হল প্রকৃত সাফল্য। পবিত্র কোরআনে সফল মুসলিমদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- তারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হেদায়াতপ্রাপ্ত আর এরাই সফলকাম। [সূরা বাকারা : ৫]

 

প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তি মাত্রই একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, যেকোন কাজে সাফল্য লাভ করতে হলে আগে লক্ষ্য নির্ধারণ করা জরুরী। নতুবা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করা সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে যে দীর্ঘ এক মাস মুসলিমদের জন্য সিয়াম পালন করা ফরজ করা হয়েছে, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে না জানলে শুধুমাত্র ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট পাওয়া ব্যতীত ইসলামের এ মহান স্তম্ভ থেকে ভিন্ন কোন উপকারিতা লাভ করার সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ সা. এ ধরনের সিয়ামপালনকারীদের ব্যাপারে আফসোস করে বলেছেন, “এমন লোকদের পানাহার থেকে বিরত থাকা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই যারা মন্দ কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে পারে না।” এই আফসোস বাণী ঐ সকল সিয়াম পালনকারীদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে যাদের কোন জ্ঞান নেই এবং এ বিষয়ে তারা মোটেও চিন্তিত নয়।

 

ইসলামের প্রতিটি বিধানের জীবনমুখী ও অন্তর্নিহিত শিক্ষাকে ‘উসূল’ বা মূলনীতি বলা হয়। যা স্কলারগণ গবেষণার মাধ্যমে উদঘাটন করেন। উসূল বা মূলনীতি মেনে চললে জীবন পরিচালনা করা নির্ভুল ও সহজ হয় এবং জীবনে বিপদগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আর মূলনীতিকে অগ্রাহ্য বা পাশকাটিয়ে চললে জীবন বিকল ও অকেজো হয়ে পড়ে। কাজেই সকলের উচিৎ মূলনীতির প্রতি ধাবিত হওয়া এবং কোরআন ও সুন্নাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা।

 

আমরা জানি সিয়াম আরবী শব্দ। এর অর্থ হল- বর্জন করা বা বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও  যৌনচার থেকে বিরত থাকা এবং সকল প্রকার পাপ কাজ বর্জন করাকে সিয়াম বলা হয়। আর রমজান মাসে সঠিক নিয়মে সিয়াম পালন করলে সিয়াম পালনকারীর মাঝে ‘তাকওয়া’ সৃষ্টি হয়। মুফাসসিরগণ বলেন, তাকওয়া হল আল্লাহর আদেশকৃত কাজসমূহ পালন করা এবং নিষিদ্ধ কাজসমূহ বর্জন করা। অর্থাৎ হালাল গ্রহন করা এবং হারাম বর্জন করা। স্কলারগণ বলেন, বর্জন করার মাঝেই তাকওয়ার সিংহভাগ নিহীত। সুতরাং আমরা সিয়াম ও তাকওয়ার মাঝে যে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থ পাচ্ছি- তা হল, বর্জন করা বা বিরত থাকা।

 

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় সিয়াম সম্পর্কিত সকল অভিভাষণ আমাদেরকে এ থেকে যে মূলনীতি গ্রহনের কথা বলে, তা হল- ‘বর্জননীতি’ (Boycott)। এ মূলনীতি মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এতই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যে, এছাড়া ক্ষতি থেকে বাঁচা যায় না। যারা যাচাই-বাছাই না করে সবকিছু গ্রহন করে এবং সবকিছুতে নিজেকে জড়ায়, তাদের জীবনে ধবংস অনিবার্য। জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার জন্য শুধুমাত্র এতটুকুন যথেষ্ট যে, গ্রহনের ক্ষেত্রে কোনপ্রকার বাছ-বিচার করা হয় না। যারা বর্জনীয় জিনিসকে বর্জন করে না বা করতে জানে না, তারা অতি সহজে ক্ষতির সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।

 

‘বর্জননীতি’ মু’মিনের এমন এক আধ্যাত্মিক (গোপন) অস্ত্র যা দ্বারা সে মানুষ ও জ্বীন শয়তানকে সহজে কাবু করে ফেলতে পারে। এজন্য রাসূলুল্লাহ সা. অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে সিয়ামকে মু’মিনের অস্ত্র (ঢাল) হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “সিয়াম হল ঢাল।” কাজেই জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই মূলনীতি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি যদি সঠিকভাবে অনুসরণ করা না হয়, তাহলে দুনিয়ার জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তিমাত্র সামনে যা কিছুই আসুক না কেন; তিনি প্রথমতঃ ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই করবেন। অতঃপর হয় তা গ্রহণ করবেন; নতুবা বর্জন করবেন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন এমনকি কুটনৈতিক ক্ষেত্রেও ‘বর্জননীতি’ একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিশাবে কাজ করে। অবশ্য তা শরীয়তসম্মত হতে হবে।

 

পবিত্র রমজান মাস আরম্ভ হওয়ার পূর্বে এমন একটি মহিমান্বিত রাত্রি রয়েছে যার নাম হল- ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা বর্জনরাত্রি। হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর অসংখ্য নেক বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন কিন্তু সাত শ্রেণীর মন্দ লোকদের ক্ষমা করেন না। অর্থাৎ- তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন বা তাদেরকে বর্জন করেন। তারা হল যথাক্রমে-

১. মদ পানকারী।

২. পুন: পুন: ব্যভিচারী।

৩. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।

৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী।

৫. চোগলখোর।

৬. কৃপণ ও

৭. এমন মুসলিম যে অন্য মুসলিমের সঙ্গে অহেতুক রাগ করে তিন দিনের অধিক সময় পর্যন্ত কথা বলা বন্ধ রাখে।

 

সুতরাং সিয়ামের অতিপ্রারম্ভ থেকে এই যে ‘বর্জননীতি’ আমরা প্রত্যক্ষ করি -তা আমাদেরকে সমগ্র রমজানজুড়ে জীবনের এক শক্তিশালী মূলনীতির প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে; যা হল সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গোপন অস্ত্র। এর মাধ্যমে যে কোন পরাশক্তিকেও পরাজিত করা সম্ভব।

 

 

Spread the love