বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ শরীয়াহ বলতে ফতওয়া এবং ফতওয়া বলতে শরীয়াহকে বুঝে থাকে। ফলে মুফতিদের ভুল মানে শরীয়াহর ভুল এবং অধিকাংশক্ষেত্রে তথাকথিত মুফতিদের ফতওয়াবাজিকে ইসলামী শরীয়াহ মনে করে। নতুন কোন সমস্যা সামনে আসামাত্র স্টাডি (ijtihad) না করে এবং ফতোয়া প্রদানের নীতিমালার [context, environment & specific situation] কোনরূপ তোয়াক্কা না করে ‘হালাল’ বা ‘হারাম’ রায় দেওয়ার অসুস্থ মানসিকতা শরীয়াহ সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এছাড়া অনর্গল ও চটকদার ভঙ্গিতে ফতওয়া প্রদান, ভিন্ন মতাবলম্বিদের ভ্রান্ত প্রমাণ করার জোরালো প্রচেষ্টা, মুফতিদের দলাদলি ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি কার্যকলাপ শরীয়াহ সম্পর্কে অনাগ্রহ সৃষ্টির জন্যও বিশেষভাবে দায়ী।
প্রথমতঃ একটি বিষয় খুব পরিস্কারভাবে জানা প্রয়োজন যে, ফতওয়া মানে শরীয়াহ নয় এবং শরীয়াহ মানে ফতওয়া নয়। বরং ফতওয়া হল শরীয়াহর একটি পার্ট বা অংশমাত্র। প্রকৃতপক্ষে শরীয়াহ দ্বারা ফতওয়াকে জাস্টিফাই বা লিগ্যালাইজ করা হয়। এজন্য কেউ যখন শরীয়াহ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান লাভ করে এবং বিধিমোতাবেক কোন রায় প্রদান করে শুধুমাত্র তখন সেটিকে ফতওয়া (legal opinion) বলা হয়। এ ব্যাপারে শর্ত হল, সে রায় অবশ্যই শরীয়াহর মৌলিক উদ্দেশ্যসমূহের অনুকূল হতে হবে। অপরদিকে শরীয়াহ হল এমন এক বিস্তৃত পরিসর; যা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বজনীন পর্যায়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি (way of life) নির্ণয় করে দেয়। যা হল মানুষসহ সমগ্র সৃষ্টিকুলের অধিকার ও মর্যাদার রক্ষাকবচ। সাধারণ অর্থে মুসলিম হওয়া এবং সে দাবীর উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পদ্ধতিকে শরীয়াহ বলা হয়।
কিছু কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে অনভিজ্ঞ মুফতিদের দুর্বল চিন্তাধারা ও রায় ফতওয়া ও ইসলামী শরীয়াহকে বিতর্কিত করে তুলেছে। যেমন- নারীদের শিক্ষা ও তাদের কর্মক্ষেত্র, নারীদের ক্ষমতায়ন, সম্পত্তি বন্টন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুদ ও ইজারা, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা, মিডিয়া ইত্যাদি। এসকল প্রশ্নে মুফতিদের ভুলভাল বিবৃতিকে মানুষ ইসলামী শরীয়াহ বলে মনে করে। ফলে স্রষ্টাপ্রদত্ত সবচেয়ে জীবনমুখী ও সহজ-সরল এ জীবনব্যবস্থা আজো নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। অথচ ইসলামী শরীয়াহর প্রধানতম লক্ষ্য হল, মানুষের জীবনকে সহজ-সরল ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করা।
মানুষের হাত-পায়ে শেকল পরানো কিংবা জীবনকে সংকুচিত করে ফেলা শরীয়াহর উদ্দেশ্য নয়। শরীয়াহর আসল উদ্দেশ্য হল, মানুষকে সুখী করা এবং জীবনের অপার সম্ভাবনার দুয়ারকে উন্মুক্ত করে দেওয়া। চোখমেলে উপরে তাকালে যেমনি সুবিশাল আকাশ দেখতে পাওয়া যায়, ইসলামী শরীয়াহর বিস্তৃতি তেমনি সীমাহীন। আর ফতওয়া শরীয়াহ নামক সুবিশাল আকাশের একটি তারার ন্যায়। ফতওয়ার কাজ হল শরীয়াহকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধশালী করা। কিন্তু কে তা বুঝে এবং কে তা মানে ?