পর্দাকে আরবীতে হিজাব বলা হয়। হিজাব অর্থ- গোপন করা, ঢেকে রাখা বা আড়াল করা। আমাদের দেশে যদিও হিজাব বলতে নারীদের মাথার উপর দিয়ে পেঁচিয়ে বুক পর্যন্ত লম্বা ওড়না বা চাদর পরিধান করাকে বুঝায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সকল পর্যায়ে নারী-পুরুষের পর্দা মেনে চলাকে হিজাব বলা হয়। সকল নবী-রাসূল (আঃ) এর উম্মতের ওপর  হিজাব মেনে চলা আবশ্যক ছিল। এজন্য আজও প্রাচীন ধর্মসমূহের অনুসারীদেরকে কম-বেশী পর্দা মেনে চলতে দেখা যায়। হিজাবের মাঝে বিশেষতঃ নারীদের আত্মমর্যাদাবোধ, সম্ভ্রম, উন্নত রুচি ও আভিজাত্যের পরিচয় ফুটে ওঠে। এটি নারীদের জন্য এমন এক অবধারিত বিষয় যে, এতদ্ব্যতীত তাঁদের অস্তিত্বের কথা কল্পনা করা যায় না!

হিজাব সম্ভ্রান্ত নারীদের পোশাক। হাদীস শরীফে এসেছে, হজরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খায়বার ও মদিনার মাঝখানে তিন দিন অবস্থান করেন এবং হজরত সাফিয়্যাহ (রাঃ) এর সাথে বিয়ে পর বাসর যাপনের ব্যবস্থা করেন। আমি মুসলমানদেরকে বিবাহ ভোজের দাওয়াত দিই। সেই ভোজে না রুটির ব্যবস্থা ছিল, না গোশতের। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রীতিভোজের জন্য দস্তরখানা বিছানোর নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তাতে খেজুর, পনির, চর্বি ও মাখন ঢেলে দিলেন। এ ছিল তাঁর বিবাহ ভোজ। মুসলিমরা এ প্রসঙ্গে পরস্পর বলাবলি আরম্ভ করল যে, তিনি (হজরত সাফিয়্যাহ রা.) কি নবী করীম (সাঃ) এর স্ত্রী না ক্রীতদাসীর মধ্যে গণ্য হবেন? অতঃপর সবাই স্থির করলেন যে, যদি হজরত সাফিয়্যাহর জন্য পর্দার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তাঁকে রাসূলুল্লাহর স্ত্রীদের মধ্যে গণ্য করা হবে। আর পর্দা করা না হলে ক্রীতদাসী মনে করা হবে। পরিশেষে যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখান থেকে রওয়ানা করলেন, হজরত সাফিয়্যাহর জন্য উটের পেছনে জায়গা করলেন এবং তাঁর ও লোকদের মাঝে পর্দার ব্যবস্থা করলেন। [সহিহ আল-বুখারি, বিয়ে অধ্যায়]। এই হাদীস থেকে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায় তা হল, তৎকালিন সমাজে যে সকল নারীরা হিজাব পরিধান করতো, তাদেরকে উচ্চ বংশীয়, সম্ভ্রান্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে গণ্য করা হতো। বিপরীতপক্ষে যারা পর্দা করতো না, তাদেরকে সাধারণ নারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

হিজাব একটি জান্নাতি পোশাক। শয়তানের প্রথম চক্রান্ত ছিল মানুষের হিজাব খুলে নেওয়া এবং পর্দাহীন করে ফেলা। শয়তান যা হজরত আদম ও হাওয়া (আঃ) এর উপর প্রয়োগ করে। ফলে উভয়ে জান্নাত থেকে বহিস্কৃত হন। পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, “অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।” [আল্‌-আরাফ,-২০]। সুতরাং এটি খুবই সুস্পষ্ট যে, আদম ও হাওয়া (আঃ) কে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষন করানো তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং সে জানতো যে, এ নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করলে শরীর থেকে জামা-কাপড় খসে পড়বে। ফলে তারা জান্নাতে বসবাসের অধিকার হারাবে।

পর্দাহীনতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ অবক্ষয়ের জন্মদাতা হল শয়তান। এরপর কাবিল, অতঃপর নূহ (আঃ) এর স্ত্রীসহ তাঁর কাওমের নির্লজ্জ নারীরা। অবনতির ধারা অব্যাহতভোবে চলতে থাকে হজরত লূত (আঃ) ও হজরত মূসা (আঃ) এর কাওমের মধ্যে। ফিরাউন এ অবক্ষয়কে আরো জঘণ্যতর পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এ অবস্থা আরও নিম্নগামী হতে হতে জাহেলি যুগ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিস্তৃতি লাভ করে। জাহেলি যুগের নারীদের বেপর্দার ইতিহাস সবচেয়ে নিকৃষ্টতর এবং কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। যারা কিনা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতো এবং কাবা ঘরে বিবস্ত্র নারী মূর্তি স্থাপন করতো! অতঃপর এমন হীন দূরবস্থা থেকে নারীদেরকে উদ্ধার করেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলমানদেরকে সঠিকভাবে হিজাব পালন করা শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে ছিল না কোন বাড়াবাড়ি এবং শীথিলতা। ফলে তৎকালীন সমাজে নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সম্মান ও সম্ভ্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার নামে চলছে বেহায়াপনা। মিডিয়ার মাধ্যমে নারীদেরকে বিশ্ববাসির সামনে পণ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে অহরহ। নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে অহেতুকভাবে নারীদেরকে বিবস্ত্র করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে অত্যন্ত নিদারুনভাবে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে নারীদের সম্মান ও সম্ভ্রম। আর এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন সব নারীদেরকে- যারা আত্মসম্মান খুঁইয়ে হলেও ক্যামেরার সামনে উলঙ্গ হতে প্রস্তুত!

হিজাব বা পর্দাকে আবার অনেকে ফ্যাশনে পরিণত করে ফেলেছে। বাজার তৈরী করেতে গিয়ে এ মূল্যবান জিনিসটিকে উপহাসের বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছে। ফলে নামেমাত্র হিজাব পালিত হচ্ছে, কিন্তু দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমত ঢাকা পড়ছে না। যা মোটেও সঠিক নয়। আবার অনেকে পর্দার বিষয়ে এতটাই কঠোর অবস্থানে চলে গেছে যে, নারীদের বাইরে বের হওয়া ও কাজ করাকে নিষিদ্ধ বলে মনে করে। ফলে নারীদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করা কঠিন ও জটিল হয়ে পড়েছে। বাস্তবে এর কোনটিই কাম্য নয়। ইসলাম কখনো কট্টর পন্থাকে অনুমোদন করে না এবং শীথিলতাকেও অনুমোদন করে না। বরং ইসলামের অবস্থান এতদুভয়ের মাঝামাঝি। অর্থাৎ পর্দা পালন করতে হবে মধ্যম পন্থায়। আর এতেই  রয়েছে সবার জন্য কল্যাণ।

হিজাবের মূলনীতি কোনোভাবে পরিবর্তনযোগ্য নয়। মানুষের রুচি পরিবর্তনশীল কিংবা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। ফলে  ইসলাম মানুষের  রুচির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কোনো বিশেষ রঙ, চাদর কিংবা কাপড় নির্ধারণ করে দেয়নি। বরং এ বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে যে, “নারী ও পুরুষদেরকে অবশ্যই কার্যকরভাবে তাদের দেহ (সতর) আবৃত করে রাখতে হবে।” (আল্‌-আহযাব, ৩৪)

পাশ্চাত্যের খোলামেলা ও চকচকে জীবন যখন থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে, তখন থেকে পর্দার ব্যাপারে অবজ্ঞা প্রদর্শন ও নানামুখী বিতর্ক আরম্ভ হয়। বস্তুবাদীরা উন্নয়নের নামে নারীদেরকে এমনভাবে পর্দাহীন করে ফেলে যে, মিডিয়ায় নারীরা আজও পণ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। উপরন্তু এমন একদল নারী জন্ম দেয়া হয়েছে, যারা কিনা পর্দাকে নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকার হানির নিয়ামক বলে মনে করে! অথচ ভুক্তভোগীদের অনেকেই এ মর্মে সতর্ক করেছিল যে, এটি পাশ্চাত্যের এমন একটি ফাঁদ; যার মাধ্যমে নারীদেরকে ইচ্ছামত ভোগ করার রাস্তা খুলে বসা হয়েছে। হলিউডের দুনিয়া কাঁপানো অভিনেত্রী ‘ব্রিজিত বার্দোতোর’ স্বপ্রকাশিত জবানবন্দী তার সবচেয়ে বড় প্রামাণ।

আজো বিশ্বময় মুসলিম নারীরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে হিজাব পরিধান করার দরুন নিগৃহীত হচ্ছে। তুরস্কে হিজাব পরা মুসলিম ছাত্রীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্যাতন; ফ্রান্স ও ব্রিটেনে শাসকগোষ্ঠীর হিজাববিরোধী আইন ও বল প্রয়োগ নতুনভাবে মুসলিম নারীদেরকে হিজাবে উজ্জীবিত হতে শক্তি-সাহস জুগিয়েছে। এসব অঞ্চলে দিনে দিনে বাড়ছে হিজাব পরা মুসলিম নারীদের সংখ্যা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে-  হিজাব পরিহিতা নারীদের প্রতি পুরুষদের আচরণ হিজাব বিহীন নারীদের চেয়ে সহনশীল এবং ইতিবাচক। এতে প্রমাণিত হয়, হিজাব নারীদের সামাজিক নিরাপত্তারও উপাদান বটে।

এসব বাস্তব কারণে হিজাব পরিধানের প্রতি বিশ্বের সকল অঞ্চলে নারীদের আগ্রহ বাড়ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন করে হিজাব পরিহিতা একজন ছাত্রী হিজাব পরার পর নিজেকে আগের চেয়ে বেশি সম্মানিত বোধ করছেন বলে একটি সাক্ষাৎকারে দেখতে পেয়েছি। তিনি এও অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, “পর্দার উদ্দেশ্যে যারা বোরখা পরিধান করে, তাদের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কেননা অনেকে এমন টাইটফিট বোরখা পরিধান করে যে, তাতে শরীর ঢাকা হলেও পর্দা হয় না।” এটি খুবই সঠিক একটি অভিমত এবং তাতে আমাদের জন্য শিক্ষনীয় রয়েছে।

বোরখা পরিধান করার ক্ষেত্রে একজন সচেতন মুসলিম নারীর যে বিষয়গুলো মেনে চলা প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ড. ইউসুফ আল্‌-কারযাভীর অভিমত হল-
১. বোরখা এমন হবে যাতে তা পুরো দেহকে আবৃত করে।
২. বোরখা এমন হবে যাতে নিচের অংশ দেখা না যায়।
৩. এমন ঢিলেঢালা হবে যাতে শরীরের কোনো অংশ বিশেষভাবে চিহ্নিত না হয়।
৪. মাথার ওপর থেকে বক্ষদেশ এবং গ্রিবাকে আবৃত করে দেয় এমন ওড়না বা চাদর ব্যবহার করা।
৫. বোরখা যেন ফ্যাশনের উপকরণ না হয়।
৬. পুরুষের পোশাকের মতো যেন না হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) তাঁর একটি গ্রন্থে পর্দার শরীয়াতসম্মত তিনটি স্তর নির্ধারণ করেছেন। যেমন-

১. প্রাথমিক স্তরঃ মুখমণ্ডল এবং হাতের কব্জি ছাড়া নারীর সমুদয় দেহ বোরখা দ্বারা আবৃত রাখা।

২. মাধ্যমিক স্তরঃ মুখমণ্ডল, হাত ও পাসহ সব কিছুই বোরখা দ্বারা আবৃত রাখা।

৩. উচ্চ স্তরঃ পুরো শরীর পর্দায় আবৃত করার সাথে সাথে পরিধেয় বস্ত্রও আবৃত করে রাখা।

কাজেই এমন কোনো কঠোরতা বা বাড়াবাড়ি নিজের ওপর আরোপ করা ঠিক নয়, যাতে নিজের স্বাভাবিক চলাফেরা ও কাজ-কর্মে ব্যাঘাত ঘটে। এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, হিজাব না পরা যেমন অজ্ঞতা তেমনি এ ব্যাপারে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করাও অনুরূপ অজ্ঞতা।

সর্বপোরি, নারীদের পূর্ণাঙ্গ পর্দা পালনে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতে পারেন পুরুষরা। যে কথাটি পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসূল সাঃ! আপনি মুমিনদের বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে।’ (আন-নূর, ৩০)। এ বিষয়টি সকলে মাথায় রাখলে পর্দা পালন অনেক সহজ হয়ে যায়। সুতরাং আমরা যদি প্রকৃত আত্মসম্মানবোধ অর্জন  করতে চাই এবং নারীদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই পর্দা পালন করতে হবে। আমাদের মা-বোন-স্ত্রীদেরকে হিজাব পরিধান করতে বলতে হবে এবং অন্যান্যদেরকেও পর্দা মেনে চলতে উৎসাহিত করতে হবে।

 

(লেখাটি দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে শেয়ার করুন…)

 

 

Spread the love