ভূমিকা: পবিত্র কোরআন মানুষের জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত সবচেয়ে বড় নিয়ামত। এর বাস্তববাদীতা মানবজাতির প্রতি বিশাল এক অনুগ্রহ। এটি সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ, যাতে মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যাবলীর বাস্তবসম্মত সমাধান পেশ করা হয়েছে। এটি অবতীর্ণের সময় থেকে আরম্ভ করে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের জন্য আল্লাহর চূড়ান্ত বিধান। কোরআনে মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ে এমনভাবে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে যে, মানুষ কোনোভাবেই এর বাস্তবতা ও সত্যতাকে অস্বীকার করতে পারে না। স্রষ্টা, আসমান-জমিন, লাওহি-কলম, মানুষ, জন্ম-মৃত্যু, ইহকাল-পরকাল, মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে এমন রহস্যপূর্ণ বর্ণনা কোরআন ভিন্ন অন্যগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। কোরআন মানুষের সর্বপ্রকার জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করে জীবনকে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত করেছে। এটি মানবজীবনের এমন এক বাস্তব চিত্রায়ন, যা আগে ঘটেছে, বর্তমানে ঘটছে এবং অনাগত ভবিষ্যতেও ঘটবে! মানবজাতির স্বভাব-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বাস্তবসম্মত বর্ণনা কেবল আল-কোরআনে পাওয়া যায়।

কোরআন অবতীর্ণের আগে মানবজীবনঃ মহাগ্রন্থ আল কোরআন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে যে ক’টি সভ্যতা মানুষের জীবনে সবচেয়ে  বেশী প্রভাব ফেলেছিল- গ্রিক, পারস্য, চীন, ভারতীয় ও আরব সভ্যতা তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ সকল সভ্যতার কোনো কোনোটি শুরুর দিকে মানবকল্যাণে অবদান রাখলেও সময়ের আবর্তে মানুষকে ঠেলে দেয় জঘন্য ও বিকৃত জীবনাচারের দিকে। এসব সভ্যতায় গড়ে ওঠা মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি, ধর্মবিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তারা ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। মানুষ প্রকৃত স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার পরিবর্তে কল্পিত অসংখ্য দেব-দেবী, মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিকৃতি এবং অসংখ্য প্রাকৃতিক বস্তুকে প্রভূ বানিয়ে নিয়েছিল। চন্দ্র, সূর্য, তারকা, বৃক্ষ, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদির পূজা-অর্চনা করতো। যদিও কোন কোন ধর্মে এখনো এমন নিদারুন অজ্ঞতা রয়ে গেছে। মানুষের উপর এ সকল সভ্যতা যে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা চালিয়েছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ ও অমানবিক। ক্ষমতাশালীদের দাপট, দুর্বলদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করা, নির্বিচারে হত্যা, লুন্ঠন, নারী নির্যাতন, দখলদারিত্ব ছিল সাধারণ বিষয়। মানুষ গণহারে ইন্দ্রিয় চর্চা এবং ভোগের উল্লাসে যে অনাচার আর বর্বরতায় ডুবে গিয়েছিল, তাতে দুনিয়া জাহান্নামের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীতে মানুষকে বিভাজন করার মাধ্যমে মানবজাতির সম্মান ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিল। বিশেষকরে নারীদেরকে পুরুষের দাসীতে পরিণত করা, জ্যান্ত কবর দেওয়া এবং তাদেরকে শুধুমাত্র যৌন সম্ভোগের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এমন বিভিষিকাময় অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অবতীর্ণ করেন মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। এ গ্রন্থের সবচেয়ে বড় অবদান হল, মানুষকে বাস্তবজীবনে ফিরিয়ে আনা।

মানবজীবনে আল-কোরআনের অবদান

প্রকৃত স্রষ্টার পরিচয় প্রদানঃ পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মানুষ কল্পিত অসংখ্য দেব-দেবী, মূর্তি, ভাস্কর্য ও বিভিন্ন প্রতিকৃতির পূজা-অর্চনা করতো। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু যেমন চন্দ্র, সূর্য, তারকা, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, বৃক্ষ ইত্যাদিকে প্রভূ মনে করতো এবং এসবের সামনে গিয়ে মাথানত করতো। পবিত্র কোরআন সর্বপ্রথম মানবজাতিকে এ সকল বস্তু অথবা বস্তুসদৃশ জিনিসের অক্ষমতা প্রমাণ করে এক এবং অদ্বিতীয় মহাশক্তিধর প্রভূ আল্লাহর পরিচয় প্রদান করেছে। প্রকৃত স্রষ্টা আল্লাহর পরিচয় জানতে পারা মানবজীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। সৃষ্টিকর্তার পরিচয় প্রদান করে পবিত্র কোরআন বলছে, “বলুন, তিনি আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি, তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।” (সূরা ইখলাস)। কোরআন আরো বলছে, “তিনি আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনিই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। অতএব তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।” (সূরা আনআম, ১০২)। আল্লাহ হলেন মানুষের বাস্তব স্রষ্টা।

মানবজীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঘোষণাঃ ইতিপূর্বে মানুষের জীবনের সুস্পষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জানা ছিলো না। মানুষ ছিলো দিকভ্রান্ত। জীবনের সঠিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঘোষণা করে পবিত্র কোরআন বলছে, “আমি মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদত করার উদ্দেশ্যে।” (সূরা জারিয়াত, ৫৬)। শুধুমাত্র আল্লাহর গুণকীর্তন করাই মানবজীবনের একমাত্র কাজ। কোরআনের ভাষায়, “সমস্ত প্রশংসা কেবল একমাত্র আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্বজাহানের প্রভু।” (সূরা ফাতিহা, ০১)। অপর এক আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন-মরণ বিশ্ব প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহর জন্য।” (সূরা আনআম, ১৬২)।

মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দানঃ পবিত্র কোরআন মানবজাতিকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। সৃষ্টিজগতের সব কিছুর ওপর মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ঘোষণা করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, “নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি। আমি তাদেরকে জলে ও স্থলে চলাচলের বাহন দান করেছি। তাদের উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি এবং তাদেরকে অসংখ্য সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা বনি ইসরাঈল, ৭০)। এছাড়া আকৃতিগত দিক থেকে মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে মর্মে কোরআন ঘোষিত হয়েছে, “আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সবচেয়ে সুন্দর আকৃতিতে।” (সূরা তীনঃ ৪)।

মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব প্রকাশঃ যুগ যুগ ধরে মানব সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ছিল বিরাট এক প্রশ্ন। মানুষের জন্ম কোনো দেব-দেবীর ইচ্ছা কিংবা আশীর্বাদের ফল নয়। কিংবা মানুষ শূন্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবিভূত স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো জীবও নয়। বরং মানুষ হলো মহান আল্লাহর নিপুণ সৃষ্টির ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নয়ন ধারার বিস্ময়কর এক দৃষ্টান্ত  ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। পবিত্র কোরআন পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মানবজাতির সৃষ্টিতত্ত্ব প্রকাশ করে মানুষের চিত্তে চিরশান্তি দান করেছে। কোরআন বলছে, “আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি। এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে হাড় সৃষ্টি করেছি। অতঃপর হাড়কে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে এক নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কতই না কল্যাণময়!” (মুমিনুনঃ ১৪-১৫)। মানব সৃষ্টির রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান কোরআনের এ ঘোষণা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে মেনে নিয়েছে।

মানবজীবন হলো পরীক্ষাগারঃ পৃথিবীর জীবন হল মানুষের জন্য একটি পরীক্ষাকেন্দ্র। মানুষকে নানাবিধ পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে কে আল্লাহর প্রতি সত্যিকারভাবে বিশ্বাসী এবং অনুগত বান্দা তা যাচাই করে নেয়া হবে। প্রমাণ করে নেয়া হবে সত্যিকারার্থে কে সত্যবাদী এবং কে মুনাফিক। পবিত্র কোরআন বলছে, “আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা ঈমানদার এবং  কারা মুনাফিক।” ( সূরা আনকাবুত, ১১)। পৃথিবীতে মানুষকে ঈমানের সত্যতার ব্যাপারে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। এ মর্মে আল কোরআন বলছে, “মানুষ কি মনে করে যে, তারা এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা ঈমানদার? অথচ তাদের পরীক্ষা করা হবে না! আমি তাদেরও পরীক্ষা করেছি যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী। (সূরা আনকাবুত, ১-৩)।

মানবজীবনে সাফল্য লাভের উপায়ঃ জীবনে কিভাবে সাফল্য লাভ করা যায় এবং সাফল্য লাভের মানদন্ড কি -প্রতিটি মানুষের কাছে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ফলে সাফল্য লাভের উপায় বর্ণনা করে কোরআন বলছে, “অতঃপর যাদের কাছে হেদায়াত (ওহী) পৌঁছেছে, তারা যদি সে হেদায়াত অনুসারে চলে, তাহলে তাদের ভীত হওয়ার কিছু নেই। আর না তারা চিন্তিত হবে।” (সূরা বাকারা, ৩৮)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, সৎ কাজ করেছে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জাকাত দান করেছে, তাদের জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্তার। তাদের কোনো শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা বাকারা, ২৭৭)। সফল ব্যক্তিদের ব্যাপারে কোরআন সুস্পষ্টভাবে বলছে, “(ঐ সকল) মুমিনগণ সফল; যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে, অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে, যাকাত দান করে এবং নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংরক্ষণ করে। (সূরা মু’মিনুন, ১-৫)। এককথায় যারা তাকওয়া অর্জন করে পৃথিবীর জীবনে তারাই সফল। কোরআনের ভাষায়, “ আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তারাই সফল ও কৃতকার্য।” (সূরা নূর, ৫২)।

মানবজীবনে বিপর্যয়ের কারণ বর্ণনাঃ নিজের অপকর্মের কারণে মানুষের জীবনে নানাবিধি বিপর্যয় নেমে আসে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সেজন্য আল্লাহকে দায়ী করে অনুতাপের সাথে বলতে থাকে,­ হায় আল্লাহ! আমি কী এমন অপরাধ করলাম, যে জন্য তুমি আমাকে এমন বিপদে ফেলে দিলে? অথচ ওই বিপদের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। পবিত্র কোরআন বলছে, “তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদেরই কর্মের ফল। বরং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” (সূরা আশ-শূরা, ৩০)। মানুষের জীবনে মানুষই দায়ী মর্মে অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমার যে কল্যাণ হয়, তা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর তোমার যে অকল্যাণ হয়, তা হয় তোমার নিজের কারণে।” (সূরা নিসা,৭৯)। অতএব, একথা পরিস্কার যে, মানুষই মানুষের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।

মধ্যমপন্থা অনুসরণের নির্দেশঃ মানুষ কোন পন্থা অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করবে পবিত্র কোরআনে তা সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। কোরআন বলছে, “আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা মানুষের জন্য অনুকরণীয় হও, যেমনিভাবে রাসূল তোমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়েছেন। (সূরা বাকারা, ১৪৩)। অপর আয়াতে আরও বিশদভাবে বলা হয়েছে, “তোমরা হলে সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (সূরা বাকারা, ১১০)। অন্যত্র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় চলার নির্দেশ প্রদান করে বলা হয়েছে, “আর তোমরা ন্যায়পরায়নতার দ্বারা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করো এবং কোনভাবে ভারসাম্য (ন্যায়নীতি) নস্যাৎ করো না।” (সূরা রাহমান, ০৯)।

পৃথিবীর জীবন সম্পর্কে সতর্কীকরণঃ মানুষ যেন পৃথিবীর চাকচিক্যময় জীবন দেখে বিমোহিত না হয় এবং আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরে না যায়, সে জন্য কোরআন মানুষকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়েছে। কোরআন বলছে, “হে মুমিনগণ! তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দুরে সরিয়ে না রাখে। যারা এ সবের মোহে দূরে সরে যায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা মুনাফিকুন, ৯)। পার্থিব জীবন ভোগবিলাসের জন্য নয়, বরং পরকালের পুঁজি আহরণের সুযোগ হিসেবে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে কোরআন বলছে, “ হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামীকালের জন্য সে কী প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা।” (সূরা হাশর, ১৮)। পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ ধন-সম্পদ লাভের প্রতিযোগিতায় মত্ত। পবিত্র কোরআন এ বিষয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছে, “নিশ্চয় মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ। এবং সে এ বিষয়ে অবগত। নিশ্চিত সে ধন-সম্পদের ভালোবাসায় মত্ত।” (সূরা আদিয়াত, ৬-৮)।

ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে পার্থক্য ঘোষণাঃ পবিত্র কোরআন মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যকার গুণগত পার্থক্য প্রকাশ করে দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে , “পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া কিছু নয়। পরকালই প্রকৃত জীবন; যদি তারা বুঝত।” (সূরা আনকাবুত, ৬৪)। ইহলৌকিক জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব বর্ণনা করে কোরআন বলছে, “পার্থিব জীবন তো কেবল সাময়িক উপভোগের বস্তু, আর পরকাল হচ্ছে স্থায়ী বসবাসের গৃহ। যে মন্দ কর্ম করবে সে কেবল তার অনুরূপ প্রতিফল পাবে। আর যে মুমিন পুরুষ বা নারী মুমিন অবস্থায় সৎ কর্ম করে তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেখানে তাদেরকে অগণিত রিজিক প্রদান করা হবে।” (সূরা মুমিন, ৩৯-৪০)। অন্যত্র বলা হয়েছে, “তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে; তা পার্থিব ভোগ ও শোভা ছাড়া অন্যকিছু নয়। আর আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উত্তম ও স্থায়ী।” (সূরা কাসাস, ৬০)।

জীবন ও মৃত্যু দানের উদ্দেশ্য বর্ণনাঃ পবিত্র কোরআন মানুষকে জীবন ও মৃত্যু দানের উদ্দেশ্য পরিস্ককারভাবে ঘোষণা করেছে। এ মর্মে কোরআন বলছে, “তিনি জীবন ও মৃ্ত্যু সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ।” (সূরা মুলক, ২)। এ সম্পর্কে কোরআন আরো বলছে, “এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যধারণকারীদেরকে, যারা বিপদে পড়লে বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।” (সূরা বাকারা, ১৫৫-৫৬)।

জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘোষণাঃ অসংখ্য মানুষ তাদের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞ। পবিত্র কোরআন মানষকে তাদের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতির কথা ঘোষণা করে বলছে, “তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে সবাইকে। আল্লাহর ওয়াদা সত্য। তিনিই সৃষ্টি করেন প্রথমবার আবার পুনর্বার তৈরি করবেন তাদের বদলা দেয়ার জন্য।” (সূরা ইউনূস, ৪)। অন্যত্র বলা হয়েছে, “অতঃপর যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে এবং একে অপরের খোঁজ নিবে না। যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হালকা হবে তারা হবে ক্ষতিগ্রস্ত। তারা জাহান্নামে চিরকাল বসবাস করবে। আগুন তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে এবং তারা তাতে বীভৎস আকার ধারণ করবে।” (সূরা মুমিন, ১০১-৪)।

মানবজীবনে উৎসাহের ফল্গুধারাঃ দুঃখ-কষ্টের মাঝে পড়ে জীবনের প্রতি মানুষ যেন উদাসীন হয়ে না পড়ে, সে জন্য কোরআন ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে বলছে, “যে একটি ভালো কাজ করবে, সে তার দশগুণ পুরস্কার পাবে এবং যে একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তি পাবে। তাদের প্রতি কোনো প্রকার জুলুম করা হবে না।” (সূরা আনআম, ১৬০)। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে যারা অনিচ্ছায় ভুল করে ফেলবে, তাদের ভুল তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা প্রদান করে কোরআন বলছে, “অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে ফেলে। অতঃপর দ্রুত তাওবা করে নেয়।” (সূরা নিসা, ১৭)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু” (সূরা জুমার, ৫৪)।

নারী জাতির মর্যাদা পুনরুদ্ধারঃ পবিত্র কোরআন পৃথিবীতে অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত নারী জাতির সম্মান পুনরুদ্ধার করেছে। পুরুষের ওপর নারীর অধিকার রয়েছে মর্মে কোরআন বলছে, “নারীদেরও অনুরূপ অধিকার আছে, যেমন পুরুষদের অধিকার আছে নারীদের ওপর।” (সূরা, বাকারা, ২২৮)। অন্য আয়াতে পুরুষদেরকে নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ প্রদান করে বলা হয়েছে, “তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে জীবন যাপন করবে।” (সূরা নিসা, ১৯)। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে নারীদের সম্মান ও অধিকারের ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা রয়েছে।

মানব চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনঃ পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে মানুষের স্বভাব চরিত্রের বাস্তব বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন এক আয়াতে বলা হয়েছে, “যখন মানুষ কোনো বিপদ-মসিবতে নিমজ্জিত হয়, তখন দাঁড়িয়ে, শুয়ে, বসে ও সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ডাকতে থাকে। আর যখন বিপদ দূর হয়ে যায় তখন এমন আচরণ করে, মনে হয় যেন সে কোন বিপদেই পড়েনি।” (সূরা ইউনূস, ১২)। একদল ঠুনকো বিশ্বাসীদের স্বভাব তুলে ধরে বলা হয়েছে, “মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয় তবে ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। আর যদি কোন সংকটে পড়ে তাহলে আগের অবস্থায় ফিরে যায়।” (সূরা হাজ্জ, ১১) অন্য এক আয়াতে সুবিধাবাদী লোকদের চরিত উপস্থাপন করে বলা হয়েছে, “এরা এমন ধরণের লোক, যারা সর্বদা তোমাদের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রতিক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। যদি আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা বিজয়ী হও তবে বলে আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?” (সূরা নিসা, ১৪১)। অপরদিকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এক দল লোক সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, “যখন তাদের বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করো না। তারা বলে আমরা তো সংস্কার কাজ করছি। জেনে রাখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।” (সূরা বাকারা, ১১)। এমনিভাবে কোরআনের বিভিন্ন অধ্যায়ে রয়েছে মানুষেন স্বভাব চরিত্রের বাস্তবসম্মত বিবরণ।

জ্ঞান সাধনা ও সত্যানুসন্ধানের আহ্বানঃ জীবনে সঠিক পথ পেতে এবং জীবনকে সার্থক ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে পবিত্র কোরআন গোটা বিশ্ব মানবতাকে জ্ঞান সাধনা এবং সত্যানুসন্ধানের প্রতি ‍উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। যার ফলে মানবজীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বস্তুত পবিত্র কোরআনের প্রথম নির্দেশ হলো জ্ঞান আহরণ করো। কোরআন বলছে, “পড়ো, তোমার পালনকর্তার নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে।” (সূরা আলাক, ১-৩)। এক আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা যানে আর যারা জানে না তারা উভয়ে সমান নয়।” (সূরা জুমার, ০৯)। অন্যত্র কোরআন বলছে, “পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির অস্তিত্ব দান করেছেন।” (সূরা, আনকাবুত, ১৬৯)। এ সকল আহ্বানের মাধ্যমে মানুষকে বাস্তবাদী হওয়ার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।

উপসংহারঃ স্বল্প পরিসরে আল-কোরআনের বাস্তববাদীতা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এ গ্রন্থের বাস্তববাদিতা এতই প্রখর যে, এটি সকল যুগ-জিজ্ঞাসার অবসান ঘটিয়েছে। মানুষের জীবন সম্পর্কে এর দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্দেশনা এতই বাস্তবসম্মত যে, একে কোন ক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। এ মহিমান্বিত গ্রন্থ মানুষকে এমন জীবন পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলে, যে পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ অনায়াসে শান্তি ও মুক্তির লাভ করতে পারে। কিন্তু অধিকাংশক্ষেত্রে কোরআনের বাস্তববাদী দর্শনকে অনুসরণ করা হয় না। ফলে মানুষের জীবনের পাতায় পাতায় দুঃখ-কষ্টের কোন অন্ত নেই। সুতরাং মানব জীবনকে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুসরণের কোন বিকল্প নেই।

 

[প্রবন্ধটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মাসিক অগ্রপথিক, ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সংখ্যায় ‘মানব জীবনে কোরআনের অবদান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।]

 

(দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে লেখাটি শেয়ার করুন…)

 

 

Spread the love