প্রচলিত শিক্ষা সম্পর্কে বিশ্বের প্রায় সব আধুনিক পণ্ডিত বক্তব্য রেখেছেন। তন্মধ্যে শিক্ষার একাডেমিক সংজ্ঞা প্রদান ও এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য তাঁরা হলেন- দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল, লক, রুশো, বেকন, রাসেল, এডামস, হোয়াইটহেড, ডিউঈ প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে শিক্ষার যে পৃথক-পৃথক অথচ প্রায় একই রকম মৌলিক সংজ্ঞা পাওয়া যায়, সবগুলো মিলিয়ে যদি একটি করা হয়, তাহলে তা হয় এমন যে- ‘শিক্ষা হল এমন এক সক্ষমতা অর্জন করার নাম যার মাধ্যমে মানুষের সামগ্রিক বিকাশ ফলপ্রসূ হয়।’

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল- এঁদের প্রত্যেকেই বলেছেন, ‘-শিক্ষা মানুষকে বদলে দেয়।’ এই বদলে দেয়ার ধরণ সম্পর্কেও সকলের বক্তব্যে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, মিল বলেছেন- “শিক্ষা কেবল মানুষের দৈহিক, মানসিক ও আর্থিক পরিবর্তনই ঘটায় না বরং এটি মানুষের পুরো সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র, আইন এবং পরিবেশকেও পরিবর্তন করে দেয়।” বিশ্লেষণে দেখা যায়, মিলের এ বক্তব্যই অন্যান্যদের বক্তব্যে কিছুটা ভিন্ন সুরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অবশ্য রাসেল কিছুটা ভিন্ন ভঙ্গিতে শিক্ষার আদর্শিক বিকাশের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন- “শিক্ষা মানুষের চিন্তা-ভাবনা, চরিত্র ও কর্মদক্ষতার উপর বিশেষ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে এবং মানুষের প্রাণশক্তি, সাহস, শৌর্য, সংবেদনশীলতা ও বিচার-বিবেচনা শক্তির বিকাশ ঘটাবে।” অপরদিকে শিক্ষার ফল কি হবে, এ ব্যাপারে সবচেয়ে গঠনমূলক বক্তব্য পাওয়া যায় প্রভাবশালী ইংরেজ দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ বেকনের রচনায়। তিনি বলেছেন- “শিক্ষার ফলস্বরূপ আমরা লাভ করি আনন্দ, সৌন্দর্য ও দক্ষতা। এর প্রধান কাজ হল বিনোদন, যা আমরা একান্ত অবসরে পেয়ে থাকি। শিক্ষার সৌন্দর্য প্রকাশ পায় আলাপ-আলোচনার সময়, বিচার-বিশ্লেষণ ও অন্যান্য কাজকর্মে।” তিনি আরও বলেছেন- “শিক্ষিত মানুষরাই সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করে এবং ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আলাদাভাবে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখে।”
বেকন সুশিক্ষিত মানুষকে আলাদা চোখে দেখেছেন। বলেছেন- “সুশিক্ষিতরাই কেবল পারে পরামর্শ প্রদান করতে, যে কোন বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে এবং কাজের সফল ইতি টানতে।” তিনি সুশিক্ষিত মানুষকে বিশাল বটবৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন। যার সুবিস্তৃত ডালপালার নিচে সাধারণ মানুষ ছায়া গ্রহণ করে থাকে।

শিক্ষার এসব মৌলিক ধারণার আলোকেই প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার (স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়) উদ্ভব হয়েছে। হোয়াইটহেড শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিকে প্রায়োগিক শিক্ষার আধুনিক সংস্করণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন- “বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে যে সব কার্য সম্পাদিত হয় যেমন শিক্ষাক্রম, শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা, শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ইত্যাদি দ্বারা যে সব উদ্দেশ্য সাধিত হয় প্রায়োগিক অর্থে তাই শিক্ষা।” ডিউঈ আবার এটি মানতে চান না। তিনি শিক্ষাকে কেবল বিদ্যালয় কিংবা প্রতিষ্ঠানের গন্ডিতে আবদ্ধ করতে রাজি নন। তিনি শিক্ষাকে পূর্ণ জীবনের বিকাশ অর্থে ধরেছেন। সমাজ, প্রতিবেশ এবং জীবনের প্রতিটি বাস্তব অভিজ্ঞতাকে তিনি শিক্ষা প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বলেছেন- “শিক্ষা একটি অবিরাম গতিশীল প্রক্রিয়া যা কেবল বিদ্যালয় কিংবা প্রতিষ্ঠানেই শেষ হয়ে যায় না, এর ব্যপ্তিকাল পুরো মানবজীবন।” এখানে যদি আমরা হোয়াইটহেড এবং ডিউঈকে একটি সমঝোতায় নিয়ে আসি তাহলে বলতে হয়, শিক্ষার ভীত রচিত হবে বিদ্যালয়ে কিন্তু এ কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলবে জীবনের শেষ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে।

এখন এর আলোকে আমরা যদি বর্তমান অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তাহলে একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ চিত্র দেখতে পাই। তা হল- আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন ছুটির ঘন্টা শেষে বিদ্যালয় ছেড়ে বেরিয়ে আসে তখন তাদের বাস্তব জীবনে শিক্ষার সেই কাঙ্খিত পরিবেশ বিরাজ করে না। অর্থাৎ তাদের বিদ্যালয়ের জীবন হয় এক রকম আর বিদ্যালয়ের বাইরের বাস্তব জীবন হয় আরেক রকম। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের বাইরেও সবসময় ইউনিফরম কিংবা আইডি কার্ড ধারণ করবে? যাতে তাদেরকে আলাদাভাবে চেনা যায়? না, এখানে উদ্দেশ্য আসলে তা নয়। বরং শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু ও শিক্ষার্থীসুলভ মনোভাবই এখানে একমাত্র কাম্য। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মাঝে এই চর্চা খুব কমই দেখা যায়।

বাস্তব জীবনে শিক্ষার প্রতিফলন সম্পর্কিত সঠিক ধারণার অভাব এ চর্চাহীনতার মূল কারণ। কেউ কেউ অবশ্য এজন্য পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকেন। সে যাহোক, এর ফলে জাতি জ্ঞানবান সমাজ ও সুনাগরিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

ববর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-চেতনা সুখকর নয়। এটি যেমনি সঠিক তেমনি এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মানুষকে এখন অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অত্যধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার অতিমাত্রিক বাণিজ্যিকীকরণের ফলে এটি এখন সবার কাছে খন্ডকালিন পাঠগ্রহণ এবং তার বদৌলতে ঝকঝকে একটি একাডেমিক সনদ প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যা মোটেও শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যের পরিপূরক নয় এবং কোনভাবেই কাম্য নয়।

আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি বাইরের মানুষ, সমাজ-সংস্কৃতি এবং পরিবেশ থেকেও সমভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থীদেরকে সবসময় চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত রেখে অনুসন্ধিৎসু জীবন যাপন করতে হবে। গভীরভাবে পড়তে হবে নিজেকে, নিজের প্রতিবেশকে, সমাজকে এবং আশ-পাশের মানুষকে। প্রতিটি ঘটনা এবং এর কার্যকারণ থেকে শিক্ষা গ্রহণে বিশেষভাবে মনোযোগী ও উদ্যোগী হতে হবে।

একটি কথা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে,  শুধুমাত্র তত্ত্ব ও তথ্য সরবরাহ বা হস্তান্তর করাকে শিক্ষা বলে না। শিক্ষার সাথে দিক্ষাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে ব্যক্তি শিক্ষা গ্রহণ করে, তার জীবনে যদি এর প্রভাব না পড়ে তাহলে তাকে প্রকৃত শিক্ষিত বলা যায় না। প্রকৃত শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য চাই অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ, মনোরম প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সহজলভ্য উপকরণ, সৎ ও আদর্শ শিক্ষক; যোগ্য ও দক্ষ প্রশাসন, পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।

শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করতে বেকন একটি মজাদার অথচ অতি বাস্তব উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন- “পড়াশুনায় অত্যধিক সময় ব্যয় করা অলসতার লক্ষণ।” বেকনের এ কথার মূল অর্থ হল- যারা কেবল পাঠ্যবই থেকে বিদ্যার্জনের মুখাপেক্ষী থাকে, তারা কখনো সুশিক্ষিত হতে পারেন না। বরং টেবিলে বসে শুধু শুধু সময় নষ্ট করা হয়। সুতরাং প্রত্যেকের কর্তব্য হল- বইয়ের পাশাপাশি প্রকৃতি, সমাজ ও পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং নিজের অর্জিত শিক্ষা ও বুদ্ধির আলোকে সমাজে অবদান রাখা।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে বেকন আরো বলেছেন- “অধ্যয়ন মানুষকে পূর্ণতা দান করে; সভা-সমিতি মানুষকে চটপটে করে আর লেখালেখি মানুষকে নির্ভুল মানুষে পরিণত করে।” কাজেই সুশিক্ষিত হতে হলে শিক্ষার এ তিনটি পর্যায়ে সবার অংশগ্রহণ থাকা উচিৎ। সব মিলিয়ে বলা যায়, শিক্ষা হল যোগ্যতা অর্জন এবং সে আলোকে জীবনকে সার্থক করে তোলা। আর যে অর্জিত শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা হয় না, তার কোন মূল্য নেই।

 

আধুনিক চিন্তাবিদদের মতে শিক্ষার কতিপয় সংজ্ঞাঃ

  • প্লেটোঃ শিক্ষা হল শিশুর নিজস্ব ক্ষমতানুযায়ী দেহ ও মনের সার্বিক বিকাশ।
  • এরিস্টটলঃ দেহ ও মনের সুষম বিকাশই শিক্ষা।
  • লকঃ শিক্ষা হল সুস্থ্য দেহে সুস্থ্য মনের বিকাশ।
  • রুশোঃ মানব শিশু পরিপূর্ণ মানুষ পর্যায়ে পৌঁছতে যা যা দরকার তাই শিক্ষা।
  • বেকনঃ যা মানুষকে দায়িত্ব পালনের যোগ্য করে তোলে তাই শিক্ষা।
  • রাসেলঃ চরিত্রের পরিপূর্ণ বিকাশে যা কিছু সহায়ক তাকে শিক্ষা বলে।
  • এডামসঃ শিক্ষা হল সচেতনতা অর্জন।
  • মিলঃ সহজাত স্বভাবের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য আমাদের যে প্রয়াস তাই শিক্ষা।
  • হোয়াইটহেডঃ জ্ঞানের প্রয়োগ দক্ষতার কৌশল অর্জন করাই শিক্ষা। এবং
  • ডিউইঃ বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা যাচাই করে যা গ্রহণ করা হয় তাই শিক্ষা।

 

https://helloteenbd.com/2019/04/07/%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE-%E0%A6%93-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AC-%E0%A6%9C%E0%A7%80/

 

Spread the love