মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হল পোশাক। পোশাক মর্যাদা ও আভিজাত্যের প্রতীক। এটি ভেতরের মানুষ সম্পর্কে অন্যের কাছে অগ্রিম বার্তা পৌঁছে দেয়। হয় তা ইতিবাচক নতুবা নেতিবাচক। পোশাক এক নিমিষে মানুষের ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ এবং রুচি-অভিরুচির জানান দেয়। ব্যক্তির গুণগত অবস্থা প্রকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি মানুষের বাহ্যিক সারসংক্ষেপও বটে। মানুষের জীবনে পোশাকের রয়েছে বহুমাত্রিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য।
প্রাচীনকালে মানুষ যখন গুহায় বাস করতো এবং সভ্যতার আলো পায়নি বলে মনে করা হয়, তখনও মানুষের মাঝে পোশাকের প্রচলন ছিল। মানুষ পশুর চামড়া দিয়ে পোশাক তৈরি করতো এবং তা পরিধান করতো। অথচ বিভিন্ন বইতে তাদের স্বল্পপোশাক পরিহিত অবস্থার চিত্র দেখানো হয়, যা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে- মানুষ কোন কালে অসভ্য ছিলো না। যিনি এ বিশ্বের প্রথম মানুষ, তিনি ছিলেন অসম্ভব জ্ঞানী এবং সভ্য একজন মহামানব (নবী)। যাঁকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল কিছুর নাম নিজে শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাঁর কাছ থেকে পৃথিবীর মানুষ শিক্ষা লাভ করেছে। কাজেই কেবল আধুনিক মানুষরাই সভ্য -এমনটা ভাবার কোন আবকাশ নেই। তবে সে সময় পোশাক তৈরি করার মত কোন কলকারখানা ছিলো না -এ কথা সঠিক। মানুষ চামড়া দিয়ে সুন্দর সুন্দর পোশাক বানিয়ে তা পরিধান করতো। বাইবেল এবং অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে এমন বর্ণনা পাওয়া যায়।
পোশাকের রয়েছে ব্যক্তিত্বগত, ঐতিহ্যগত, প্রাতিষ্ঠানিক, জাতীয়, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব। বর্তমান যুগে পোশাকের প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী। ব্যবসা-বাণিজ্য ব্রাণ্ডিং (branding) করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে নির্ধারিত পোশাক বা ড্রেসকোড মেনে চলতে হয়। এছাড়া নিরাপত্তাবাহিনী থেকে আরম্ভ করে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা এবং বিভিন্ন এন.জি.ও প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত পোশাক পরিধান করার বিধান রয়েছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, পোশাক মানুষের শ্রেণী ও পেশাগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং তা বিশেষায়িতকরণ বা ব্রাণ্ডিংয়ের অন্যতম একটি মাধ্যম।
পোশাক ব্যক্তিত্বের একটি বিশেষ অংশ। এর মাধ্যমে নিজের মূল্যবোধ ও আদর্শকে অন্যের কাছে সহজে তুলে ধরা যায়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। কোন কোন ক্ষেত্রে পোশাকের রয়েছে আরও ক্রিয়াশীল সামর্থ। যেমন- ষাটের দশকে চীনের ক্ষমতাশালী কমিউনিস্ট নেতা মাওসেতুং মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানান। এশিয়ার বিপ্লবী নেতা হিসাবে মাওলানা ভাসানীর নামডাক তখন চতুর্দিক। সময়টা ছিল শীতকাল। চীনে তখন খুব শীত পড়ছিলো। কিন্তু মাওলানা ভাসানী তখনও স্বভাবসুলভ শুধু লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত হন। মাওসেতুংয়ের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রাক্কালে তাঁকে একটি কালো গাউন পরতে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তা পরতে অস্বীকৃতি জানান। বৈঠকে মাওসেতুং মাওলানা ভাসানীকে প্রচন্ড শীতের মাঝেও গাউনটি না পরার কারণ জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে মাওলানা ভাসানী বলেন- “আমি এখানে গরম খাইতে আসি নাই। এসেছি আমার দেশের মানুষের কষ্টের কথা তোমাদেরকে জানাইতে। তোমরা আমাকে দেখ এবং অনুমান কর, কিভাবে আমার দেশের মানুষ জীবন যাপন করে। গাউন দিয়া আমাকে ঢাকিয়া দিলে তো তোমরা কিছুই বুঝবা না।” চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাওসেতুং সেদিন মাওলানা ভাসানীকে দাঁড়িয়ে স্যালুট করেছিলেন।
রুচিশীল এবং মানস্মমত পোশাকের কদর সর্বত্রই আছে। যে কোন সভা-সমিতিতে মানসম্মত পোশাক ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তবে আবার শুধু পোশাক দিয়ে মানুষকে বিবেচনা করা ঠিক নয় এবং পোশাকের মাঝে সবকিছু নিহীত নয়। ইরানের শ্রেষ্ঠ কবি শেখ সা’দীর কথা কার না অজানা? একবার তিনি কোন এক রাজকীয় সভায় যোগদান করতে গিয়েছিলেন; যে সভার তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। কিন্তু সাধারণ মানের পোশাক পরে যাওয়ায় তাঁকে প্রথমে ঐ সভায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে তিনি যখন পোশাক পাল্টে সেখানে উপস্থিত হন, সবাই তখন কবিকে নিয়ে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠে। সভা শেষে তাঁর সামনে যখন হরেক রকম খাবার পরিবেশন করা হয়, তিনি তখন অদ্ভুতভাবে খাবারগুলো পকেটে ঢুকাতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন- “আজকের এ সকল দামী খাবারের একমাত্র উপযুক্ত হল এই পোশাক। কেননা এ পোশাক দেখেই আমাকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে।” কবির এমন কর্মকাণ্ডে সবাই ভুল বুঝতে পারে।
দামী অথচ উদ্ভট পোশাকের চেয়ে রুচিশীল এবং মননশীল পোশাক উত্তম। বর্তমানে পোশাকের বাজারে ফ্যাশন একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কুরুচিপূর্ণ এবং পোশাকের মার্জিতভাব বিলুপ্ত করে দিয়েছে। জাতীয়তা, ঐতিহ্য ও শালীনতা বিবর্জিত ফ্যাশন কোনক্রমে গ্রহনযোগ্য নয়। উদ্ভট ও ছেঁড়াফাটা ফ্যাশন মানুষের মানহানি করে এবং ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অপরদিকে কমদামী হলেও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং রুচিসম্মত ডিজাইনের পোশাক ব্যক্তিত্বকে করে মজবুত ও সুদৃঢ়।
লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন…