ধর্মের নামে, ধর্মের আড়ালে, ধর্মকে পুঁজি করে ও ধর্মের অপব্যবহার করে নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করাকে ধর্মব্যবসা বলে। অতিসুক্ষ ও গোপনে মানব সমাজে এ ব্যবসা চলে। প্রাচীনকাল থেকে এ ব্যবসা রমরমা। এতে সময়ে সময়ে ভাটা পড়ে ঠিক কিন্তু ধর্ম চিরন্তন বলে এ ব্যবসাও চিরন্তন। ধর্মব্যবসার উদাহরণ হল বটবৃক্ষের গায়ে বেড়ে ওঠা পরগাছার মত। পরগাছাকে যেমন বটবৃক্ষ থেকে সহজে আলাদা করা যায় না বা চেনা যায় না, তেমনি ধর্মব্যবসায়িদেরকেও ধার্মিকদের মাঝ থেকে আলাদা করা যায় না বা চেনা যায় না।

ধর্মের অপব্যবহার সমগ্র বিশ্বব্যাপী এবং সকল ধর্মেই বিদ্যমান। কিন্তু কোন কোন ধর্মের এতটাই অপব্যবহার হয়েছে এবং এ ব্যবসা এতটাই জমজমাট হয়েছে যে, শেষতক আস্ত ধর্মটাকেই গিলে ফেলা হয়েছে! বাকি পড়ে আছে শুধু এর খোলসটা। কাজেই এটি চিরন্তন এমন এক ব্যবসার নাম যা সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়।
এবার আসা যাক ধর্মব্যবসায়ির পরিচয়ের দিকে। যে বা যারা নিজের বৈষয়িক সুবিধাদি অর্জনের জন্য যেমন রুটি-রুজির জন্য, প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য, ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা অর্জনের নিমিত্তে, বিত্ত-বৈভব ইত্যাদির নেশায় অত্যন্ত সুক্ষভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে, তিনি বা তারা ধর্মব্যবসায়ি। কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধিরা লোকসমাজে সাধু সাজার নিমিত্তে ধর্মব্যবসা করে থাকে। বিভিন্ন দরবার, দরগাহ, ডেরা, আস্তানা ইত্যাদির সাথে তাদের থাকে নিবিড় সম্পর্ক।

ধর্মব্যবসার মূলে নিহীত থাকে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা। যা সাধারণ জনগণের চোখে সহজে ধরা পড়ে না। এর পেছনে থাকে অলস জীবন-যাপনের আশা, অর্থ-সম্পদের লোভ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা অর্জনের লোভ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করার অদম্য খায়েস। এসব পাওয়ার আশা একজন ব্যক্তিকে বিশেষ সুরতের আড়ালে ধর্মব্যবসায়িতে রূপান্তরিত করে। যাকে কিনা এক আল্লাহ ছাড়া কেউ চিনতে পারে না এবং মানুষ তার ব্যাপারে থাকে অন্ধ।

ধর্মব্যবসায়িরা অনেকটা প্রকৌশলী বা ইঞ্জিনিয়ারের মতো। তারা সুক্ষ্ম পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে এবং সময় ও সুযোগ মত কলা-কৌশলে পরিবর্তন নিয়ে আসে। তারা প্রয়োজন অনুসারে ধর্মীয় বিধি-বিধানের উপর হাত দেয় এবং তাতে পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাদের এ কাজে ক্ষমতাশালীদের প্রচ্ছন্ন সহায়তা থাকে এবং তারা তা আনুকূল্য লাভের উদ্দেশ্যে করে থাকে। এজন্য প্রত্যেক যুগেই এক শ্রেণীর ধার্মিকরা সবসময় শাসকগোষ্ঠীর সাথে সুসম্পর্ক রাখে এবং তাদের তোষামোদ করে চলে । যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম উদাহরণও রয়েছে। ফলে তাদেরকে ন্যায়পরায়ণতার জন্য শাসকদের বিরাগভাজনে পরিণত হতে হয় এবং জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়।

ধর্মব্যবসায়ীরা সাধারণত অজ্ঞ বা ধর্মান্ধ হয় না বরং তারা হয় জ্ঞানপাপী এবং ধর্মের অপব্যবহারকারী। তারা হয় এমন ধরণের চতুর ব্যক্তি, যারা মূর্খ নয় কিন্তু চারপাশে মূর্খদের সমাবেশ ঘটিয়ে তাদের দ্বারা কার্যসিদ্ধি করে থাকে। ধর্মীয় জ্ঞান এদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। এরা যে যত জ্ঞানী, তার ব্যবসাও তত বড়, তত সহজ এবং তত লাভজনক। কেননা মূর্খ লোকেরা তাদেরকে মুক্তির কাণ্ডারি বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। অধিকাংশ মানুষ ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার ফলে তারা এ সুযোগটি লাভ করে এবং তাদের ব্যবসা আরও জমজমাট হয়।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- ধর্মব্যবসায়িরা বিত্ত-বৈভবের লোভে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে এবং স্বল্পমূল্য ধর্মকে বিক্রি করে খায়। শুধু তা নয়, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং রীতি-নীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন [বিদআত] নিয়ে আসে। তারা নিজেদেরকে ধর্মীয় উপাসনালয়ের মালিক ও সংরক্ষক মনে করে এবং ধর্মকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়। [জানতে হলে পড়ুন ম্যাকিয়াভ্যেলির রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যকার বিরোধের ইতিহাস]। তারা মানুষকে এই বলে কাজে ফেরত পাঠায় যে, ‘তোমরা খাও-দাও স্ফূর্তি কর, আমরা তোমাদের পুণ্যের গোলা ভরিয়ে দেবো।’

ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় বিধিবিধান পরিবর্তনের কাজ সাধারণত কোন ধর্মান্ধ ব্যক্তিকে দিয়ে হয় না। বরং সাধারণের মাঝে যারা জ্ঞানী ও পণ্ডিত হিসাবে পরিচিত তারা এ কাজটি করে। অথচ সাধারণ মানুষ মূর্খতাবশতঃ তাদের পরম আনুগত্য পোষণ করে। এতে অবশ্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তারা কাউকে আনুগত্য করতে বাধ্য করে না। এক্ষেত্রে অনুগত্যকারীরাই দায়ী।

ধর্মব্যবসা জমজমাট হওয়ার মূল কারণ যদি খোঁজা হয় তাহলে দেখা যায় যে, ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন কিছু অসাধু ও কপট লোক যেমন এজন্য দায়ী, তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী হল ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। যারা মনে করে ধর্ম মানেই হল কিছু লেবাসধারীদের কাছে গিয়ে পড়ে থাকা আর তাদের কথা শুনে লম্পঝম্প করা। কাজেই ধর্মব্যবসা রোধ করতে হলে সর্বাগ্রে সাধারণ মানুষের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞানের আলো প্রজ্জলিত করতে হবে। সর্বস্তরে ধর্মের সঠিক জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে। এ কাজে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, ভবিষ্যৎ তাদের জন্য অপেক্ষমান। কেননা প্রায় সকল ধর্ম এ সমস্যায় কম-বেশি আক্রান্ত।

ধর্ম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ এক নিয়ামত। এটি মানুষের রক্ষাকবচ ও শান্তিপূর্ণ জীবনপথ। বিপরীতপক্ষে ধর্মব্যবসা হল এক প্রকার নির্যাতন, নিষ্পেষণ, কুলিনতা ও ঘৃণ্য শ্রেণী বৈষম্য। যা মানবতাবিরোধী ঘোরতর অপরাধও বটে।

 

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন…

 

Spread the love