পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রাপ্ত বয়ষ্ক সকল মুসলিম নর-নারীর জন্য পর্দা মেনে চলা অত্যাবশ্যক (ফরজ) করে দিয়েছেন। পর্দাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও বিধিবিধান কোরআনের সূরা আহযাব, সূরা নূর ও সূরা আ‘রাফে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআনে পর্দা সম্পর্কিত প্রথম নির্দেশনা উম্মুল মুমিনীন হজরত জয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ) এর সাথে রাসূূূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিবাহের সময় অবতীর্ণ হয়। হজরত আনাস (রাঃ) বলেন, পর্দাসংক্রান্ত প্রথম আয়াত নাজিল হয় পঞ্চম হিজরির জিলকদ মাসে, যখন রাসূূূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে জয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ) এর শুভবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। (রূহুল মা’আনী)। কারো কারো মতে, এ সময়টি ছিল তৃতীয় হিজরি। আবার কারো মতে পঞ্চম হিজরি। ইমাম ইবনে কাছির (রহঃ) তাঁর তাফছির গ্রন্থে পঞ্চম হিজরিকে অগ্রগণ্যতা দিয়েছেন। সময়কাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও এ বিষয়ে সবাই একমত যে, পর্দাসংক্রান্ত প্রথম আয়াত এ বিয়ের সময়ে অবতীর্ণ হয়। আর তা হলো পবিত্র কুরআনের সূরা আহজাবের ৫৩ নং আয়াত। আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,

“হে মুমিনগণ! তোমাদের অনুমতি দেয়া না হলে তোমরা খাওয়ার জন্য আহার্য রন্ধনের অপেক্ষা না করে নবীগৃহে প্রবেশ করো না। তবে তোমাদের ডাকা হলে প্রবেশ করো। অতঃপর খাওয়া শেষে আপনা আপনি চলে যেয়ো, কথাবার্তায় মশগুল হয়ে যেয়ো না। নিশ্চয় এটা নবীর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কাছে সঙ্কোচ বোধ করেন; কিন্তু আল্লাহ সত্য কথা বলতে সঙ্কোচ করেন না। তোমরা তার পত্নীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।”

এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সহিহ বুখারি শরীফে হজরত আনাস (রাঃ) থেকে একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যা এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘পর্দার আয়াত সম্পর্কে আমি সর্বাধিক জ্ঞাত। কারণ, আমি ছিলাম এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। হজরত জয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ) বিবাহের পর বধূবেশে রাসূূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে তার ঘরে উপস্থিত হন। আল্লাহর রাসূূূল ওয়ালিমার জন্য কিছু খাদ্য প্রস্তুত করেন ও সাহাবিদেরকে দাওয়াত করেন। খাওয়ার পর কিছু লোক পারস্পরিক কথাবার্তার জন্য সেখানে অনড় বসে রইল।’

তিরমিজি শরীফের বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং হজরত জয়নবও ছিলেন। তিনি সঙ্কোচবশত দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিলেন। লোকজন এভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কারণে রাসূূলুল্লাহ (সাঃ) কষ্ট অনুভব করছিলেন। তিনি গৃহ থেকে বের হয়ে অন্য স্ত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ ও সালামের জন্য চলে গেলেন। অতঃপর ফিরে এসে দেখলেন, লোকজন এখনো বসে রয়েছে। রাসূূলুল্লাহ (সাঃ) কে  দেখে তাদের হুঁশ ফিরে এলো ও তাঁরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। এরপর রাসূূলুল্লাহ (সাঃ) গৃহে প্রবেশ করলেন ও অল্পক্ষণ পরেই আবার বেরিয়ে এলেন।’

হজরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি সেখানেই উপস্থিত ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই এ আয়াতখানা তেলাওয়াত করে শোনান, যা তখনই অবতীর্ণ হয়।’

হজরত আনাস (রাঃ) আরো বলেন, ‘এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মুসলিমরা পর্দা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।’

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম নারীদেরকে পর্দা মেনে চলার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করেন এই সূরারই (আহযাব) ৫৯ নং আয়াতে। আল্লাহ বলেন,

“হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণ ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।”

এই আয়াতে প্রচ্ছন্নভাবে দু’টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত, নারীদেরকে তাদের বস্ত্রের ওপর ‘জিলবাব’ পরিধান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জিলবাব হলো বিশেষ ধরনের লম্বা চাদর। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, এই চাদর ওড়নার ওপর পরিধান করা হয় যা মাথার ওপর দিক থেকে পেঁচিয়ে বক্ষের ওপর রাখা হয়। (ইবনে কাছির) দ্বিতীয়ত, নারীরা যদি নিজেদের জিলবাব দ্বারা ঢেকে নেয় তবে তারা দুশ্চরিত্র লোকদের থেকে নিরাপদে থাকবে এবং তারা সম্মানিত হিসেবে বিবেচিত হবে।

পবিত্র কোরআনে চূড়ান্তভাবে যে আয়াতে আল্লাহতায়ালা নারীদের জন্য পর্দা মেনে চলা ফরজ করে দেন তা হলো, সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াত। আল্লাহ বলেন,

“তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে; বর্বর যুগের অনুরূপ নিজেদের প্রদর্শন করবে না। নামাজ কায়েম করবে, জাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূূূলের আনুগত্য করবে।”

মুফাচ্ছিরগণ বলেন, এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নারীদের ঘরে অবস্থান করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তবে প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বের হওয়া নিষিদ্ধ নয়, বরং সৌন্দর্য প্রদর্শন এবং অহেতুক ঘোরাফেরার উদ্দেশে বের হওয়া নিষিদ্ধ। বিশেষ প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে পর্দা করে ঘরের বাইরে বের হওয়ার অনুমতি আছে। (মাআরেফুল কোরআন)।

নারীদের পর্দা সংক্রান্ত বিধান অবতীর্ণ করার পর সূরা নূরের ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পুরুষদেরকে পর্দা মেনে চলার নির্দেশ প্রদান করে বলেন,

“হে নবী! আপনি মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।”

পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পুনরায় নারীদের পর্দা সম্পর্কে বলেন,

“হে নবী! আপনি মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত রাখে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীরা, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপনীয়তা প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর সমীপে প্রত্যাবর্তন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।”

পরপর এ দুটি আয়াতে পুরুষ এবং নারীদেরকে  সম্বোধন করার মাধ্যমে পর্দা মেনে চলার ক্ষেত্রে উভয়ের সমন্বিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা সুস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

সূরা নূরের ৫৯-৬১ নং আয়াতে পারিবারিক পর্যায়ে পর্দার বিধান সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

“হে মুমিনগণ! তোমাদের দাসদাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি তারা যেন তিন সময়ে তোমাদের কাছে অনুমতি গ্রহণ করে। ফজরের নামাজের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা বস্ত্র খুলে রাখো এবং এশার নামাজের পর। এই তিন সময় তোমাদের দেহের বস্ত্র খোলার সময়। এ সময়ের পর তোমাদের ও তাদের জন্য কোনো দোষ নেই। তোমাদের একে অপরের কাছে তো যাতায়াত করতেই হয়।”

“তোমাদের সন্তানসন্ততিরা যখন বয়োপ্রাপ্ত হয়, তারাও যেন তাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় অনুমতি চায়। এমনিভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতগুলো তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।”

“বৃদ্ধা নারী, যারা বিবাহের আশা করে না, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের বস্ত্র খুলে রাখে। তাদের জন্য দোষ নেই, তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।”

“অন্ধের জন্য দোষ নেই, খঞ্জের জন্য দোষ নেই এবং তোমাদের নিজেদের জন্যও দোষ নেই যে, তোমরা আহার করবে তোমাদের গৃহে অথবা তোমাদের পিতাদের গৃহে অথবা তোমাদের মাতাদের গৃহে অথবা তোমাদের ভাইদের গৃহে অথবা তোমাদের বোনদের গৃহে অথবা তোমাদের পিতৃব্যদের গৃহে অথবা তোমাদের ফুফুদের গৃহে অথবা তোমাদের মামাদের গৃহে অথবা তোমাদের খালাদের গৃহে অথবা সেই গৃহে; যার চাবি আছে তোমাদের হাতে অথবা তোমাদের বন্ধুদের গৃহে। তোমরা একত্রে আহার করো অথবা পৃথকভাবে আহার করো, তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করো, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণকর ও পবিত্র দোয়া। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা বুঝে নাও।”

অপরদিকে সূরা নূরের ২৭-২৮ নম্বর আয়াতে সামাজিক পর্যায়ে পর্দার বিধান সম্পর্কে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে,

“হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না করো এবং গৃহবাসীদের সালাম না করো। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, এটি তোমরা স্মরণ রাখো।”

“যদি তোমরা গৃহে কাউকে না পাও তবে অনুমতি গ্রহণ না করা পর্যন্ত সেখানে প্রবেশ করবে না। যদি তোমাদের বলা হয় ফিরে যাও, তবে ফিরে যাবে। এতে তোমাদের জন্য অনেক পবিত্রতা আছে এবং তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানেন।”

উপরোল্লিখিত আয়াত দুটিতে সামাজিক পর্যায়ে পর্দা পালনের পথকে সুগম করার জন্য সে সকল ভদ্রতা (etiquette) মেনে চলার কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো-

  • হুট করে অন্যের ঘরে বা রুমে প্রবেশ না করা।
  • আগে পরিচিত হওয়া, তারপর কারো বাসায় যাওয়া।
  • ঘরে প্রবেশের আগে সালাম করা।
  • পুরুষদের অনুপস্থিতিতে একাকী নারীদের ঘরে প্রবেশ না করা।
  • বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে বা রুমে প্রবেশ না করা।
  • অনুমতি না পেলে ফিরে আসা এবং এতে মাইন্ড না করা।

সূরা আরাফের ২৬-২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোটা মানবজাতিকে পর্দা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং পর্দা সম্পর্কে মানুষ জাতে বিভ্রান্তিতে না পড়ে, সে জন্য হজরত আদম ও হাওয়া আঃ-এর ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন,

“হে বনি আদম! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার বস্ত্র এবং তাকওয়ার পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে।”

“হে বনি আদম! শয়তান যেন তোমাদের বিভ্রান্ত না করে; যেমন সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে এমতাবস্থায় যে, তাদের পোশাক তাদের থেকে খুলিয়ে দিয়েছে যাতে তাদের লজ্জাস্থান প্রকাশিত হয়ে পড়ে । সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখো না। আমি শয়তানদের তাদের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছি, যারা বিশ্বাস করে না।”

কাজেই একবার ভাবুন, পর্দা সম্পর্কিত বিষয়গুলো মহান আল্লাহ স্বয়ং কিভাবে খুলেখুলে বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কিত কোন একটি বিষয়কি কি পবিত্র কোরআনে আলোচনা থেকে বাদ পড়েছে? কাজেই এ বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন।

আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে ভালোবাসেন যারা পবিত্রতা অবলম্বন করে এবং আল্লাহর বিধানের দিকে ফিরে আসে।

 

(দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে লেখাটি শেয়ার করুন…)

 

 

Spread the love