বিগত প্রায় তিন শতকেরও অধিক সময়ধরে ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। উচ্চতর জ্ঞান-গবেষণা না হওয়া, ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা যুগোপযোগী না হওয়া,  ভুলভাল রায়ের আধিক্যতা, শরীয়াহ আইনের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার, নবতর সমস্যাবলীর শরীয়াহসম্মত সমাধান পেশ করতে না পারা, অপপ্রচার, মতভিন্নতা, ফতওয়াবাজি ইত্যাদির ফলে ইসলামী শরীয়াহ প্রবলভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে শরীয়াহ সম্পর্কে জনমনে যে ভীতি ও ভুলধারণা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। তবে ইতিমধ্যে ইসলামী শরীয়াহর বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ‘মেথড’ দাঁড়িয়ে গেছে। যাকে ‘ইসলামী শরীয়াহর প্রয়োগনীতি’ [the methodology of implementation of Islamic Shariah] নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ লক্ষ্যে ফতোয়া বিশুদ্ধকরণ প্রকল্প হিশাবে মুফতিদের ‘মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ’ জানা ও মানাকে অত্যাবশ্যক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে ফতোয়া প্রদান করে থাকে, দুঃখজনক ব্যপার হল, তাঁদের অধিকাংশ এ বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান রাখেন না।

 

ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে বিশেষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা আখ্যায়িত করা হয়। যার সংক্ষিপ্ত নাম হল- ইসলামী শরীয়াহর প্রয়োগনীতি। অর্থাৎ কেউ যদি শরীয়াহ আইন নিজ পরিবারে, সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে প্রয়োগ করতে চায়, সে জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। যেমন- কেউ যদি চুরির শাস্তি হিসেবে চোরের হাত কর্তন করার আইন প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে সমাজকে একটি সুনির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও নৈতিকভাবে স্বাবলম্বী (স্থিতিশীল) রাখতে হবে। সমাজের প্রতিটি নাগরিক যখন একটি উচ্চমানের বিত্তশালী জীবনকাল অতিবাহিত করতে সক্ষম হবে এবং গবেষকদের মতে তা নুন্যতম পাঁচ থেকে সাত বছর স্থায়ী হতে হবে, তখনই কেবল উক্ত আইন (হদ) প্রয়োগ করা যাবে। শরীয়াহ আইনের এমন বাস্তব সম্মত ও যৌক্তিক নীতিকে ‘ইসলামী শরীয়াহর প্রয়োগনীতি’ (تطبيق الشريعة الإسلامية) বলা হয়।

 

ইসলামী শরীয়াহর এ প্রয়োগনীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ধরেই কোন রাষ্ট্রে চূড়ান্তভাবে শরীয়াহ আইন চালু করার সুযোগ নেই। বরং এতে এমন এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বলা হয়, যাতে গ্রাজুয়্যালি বা ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ আইন অনুসরণ করার দিকে ধাবিত হতে হয়। কাজেই ধরেই কারও উপর পূর্ণাঙ্গ শাস্তি আরোপ করা বেইনসাফি ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ। ইসলামী শরীয়াহ মানুষকে অভাবী ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় রেখে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন না ঘটিয়ে চুরির শাস্তি হিশাবে হাত কেটে দেওয়াকে বৈধ মনে করে না। ফলে প্রতিটি অপরাধের পূর্ণাঙ্গ কারণ (ইল্লাহ) পূর্ণাঙ্গভাবে মোচন হওয়া ব্যতীত চূড়ান্ত শাস্তি কার্যকর করার সুযোগ কারোর নেই। তবে চোরকে একেবারেই শাস্তিহীন অবস্থায় ছেড়ে দেয়াও নীতিবান্ধব কাজ নয়। বরং সামাজের বাস্তব অবস্থার প্রতি লক্ষরেখে উপযুক্ত শাস্তি প্রণয়ন করা এ প্রয়োগনীতির অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশ এ পন্থা অনুসরণ করে চলছে। কিন্তু অধিকাংশ মুফতির রায় হল- এ সকল রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যাবে না; কেননা তারা পূর্ণাঙ্গ শাস্তি কায়েম করছে না। যদিও তারা ইসলামী শরীয়াহর প্রয়োগনীতি অনুসরণ করে চলছে।

 

 

Spread the love