ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা [positive thinking] একটি মৌলিক মানবিক গুণ। কোন বিষয়ে বিপরিতমুখী বা একাধিক মত ক্ষতিকর বা নেতিবাচক কিছু নয়। বরং যে কোন বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ মত ও ব্যতিক্রমী চিন্তার আধিক্যতা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ যেন এক ঝুড়িতে অনেকগুলো ফল এবং সেখান থেকে সবচেয়ে ভালো ফলটি বেছে নেওয়ার মতো ব্যাপার। ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা পাণ্ডিত্য, মানসিক বলিষ্ঠতা ও পরিপক্কতার প্রমাণ বহন করে। এটি মনোবিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সুস্থ্য সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিকাশে এর কোন বিকল্প নেই। এর উপর ধর্মীয় এবং আদর্শিক ঐক্য অনেকাংশে নির্ভর করে। কাজেই ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা।
ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার অধিকারী হতে হলে নিজেকে নিজের শিক্ষক হতে হয়। এ ক্ষেত্রে অন্যের ভূমিকা গৌণ। এ গুণ অর্জনে দীর্ঘ মেয়াদি চেষ্টা-প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। নিয়মিত আত্মসমালোচনা ও ধ্যান ব্যতীত পরিশুদ্ধ চিন্তা-ভাবনার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। মোটকথা শুধু জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হলে চলবে না বরং নিজের চিন্তা-ভাবনার লাগাম টেনে ধরার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ঐক্যকে ত্বরান্বিত করে। ভেদাভেদ কমিয়ে এনে সকলকে মুক্তার দানার মত এক সুতোয় গেঁথে দেয়। কেননা ইতিবাচকতার অর্থই হল- অন্যের ভালো গুণগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং খারাপ গুণগুলোর দিকে না তাকানো। ফলে দূরত্ব কমে গিয়ে নৈকট্য অর্জনের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। যেমন- যিনি স্রষ্টাকে যত ভালো জানেন তিনি তাঁর তত নৈকট্য অর্জন করেন। আর যিনি স্রষ্টাকে যত খারাপ জানেন তিনি তত দৌরাত্ম্য অর্জন করেন। কাজেই ঐক্য হল ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা এবং উদার মানসিকতার ফল।
ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা ব্যতীত কোন বিষয়ের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আর সঠিক মূল্যায়ন ব্যতীত সঠিক মতামত প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটিতো স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, কোন বিষয়ে সঠিক অনুসন্ধান এবং সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতীত কোন প্রকার মন্তব্য [comments] করা শুধু বেঠিক নয়, অনৈতিকও বটে। এতে অন্যকে খুব ভালোভাবেই অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সুতরাং অজানা এবং অস্পষ্ট বিষয়ে চুপ থাকাই হল ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার পরিচয়।
অনেকে না জেনে না বুঝে নিজের আয়ত্তের বাইরের বিষয়েও বিচক্ষণ ব্যক্তির মত মন্তব্য করে থাকে। এটি সম্পূর্ণরূপে ইতিবাচক চিন্তাবিরোধি কাজ। এতে ঐক্য বিনষ্ট নয় এবং অস্থিরতা বেড়ে যায়। দেখা যায়- অনেকে আলোচনা-সমালোচনায় কোন প্রকার যুক্তি ও ভদ্রতার তোয়াক্কা না করে কুটতর্ক ও অভদ্রতার আশ্রয় গ্রহণ করে। এ প্রবণতা যে সমাজে যত বেশি দেখা যাবে সে সমাজ তত বেশি নেতিবাচক। ফলে সেখানে অনৈক্য ও ভেদাভেদ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতামত সেন্সর করার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকার ফলে মুহূর্তের মধ্যে যে কেউ অন্যের সম্মানে আঘাত হানার সুযোগ পায়। এতে মানসিক চাপ ও অস্থিরতা খুব দ্রুত বেড়ে যায়। কাজেই কোন বিষয়ে নিজের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি ফলানোর পূর্বে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। আমাকে কে পায় -এই ভেবে অন্যকে আঘাত করা এবং নিজেকে জাহির করার প্রবনতা ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার গুণ অর্জন করার পথে প্রধান অন্তরায়। এ বিষয়ে সতর্ক না হলে অচিরেই তা জাতিবিনাশী ভয়াবহ ব্যাধিতে রূপ লাভ করবে।
অনেককে ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে স্বেচ্ছা প্রনোদিত হয়ে ফতোয়া প্রদান করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে চরম এক নেতিবাচক প্রবনতা হল, ফতোয়া দিয়ে অন্যকে বেদ্বীন প্রমাণ করার জোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হওয়া। অথচ নিজেকে নিজে ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধিকারী মনে করার অর্থ হল এ বিষয়ে নিজেকে অধিকতর অযোগ্য বিবেচিত করে তোলা। মানুষকে জোরপূর্বক দ্বীন ও ঈমান থেকে বের করে দেওয়া খুবই নিন্দনীয় কাজ। অথচ কতিপয় লোক এই নিন্দনীয় কাজটিই অহরহ করে থাকে। অনেকে আবার অন্যকে দ্বীন বিরোধী সাব্যস্ত করতে গিয়ে নিজেই দ্বীন বিরোধী কাজ করে ফেলে এবং নিজে ঐ ব্যক্তির চাইতে দ্বীনের বেশি ক্ষতি করে ফেলে। জোরপূর্বক কাউকে দ্বীন থেকে বের করে দেওয়া কোন দ্বীনদার ব্যক্তির কাজ নয়। উপযুক্ত আলেমগণ কখনো এমনটি করেন না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে এটি সম্পূর্ণরূপে পরিশুদ্ধ ও ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা বিরোধী কাজ।
ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার ধর্মীয় দৃষ্টান্ত দেখুন! এক ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফা রহ.’র নিকট এসে জিজ্ঞেস করল- “হে ইমাম! এক লোক নিজেকে মুসলিম দাবি করে কিন্তু সে জান্নাতে যাবার আশা করে না, জাহান্নামকে ভয় পায় না, মৃত প্রাণি ভক্ষণ করে, সালাত পড়ে কিন্তু রুকু-সিজদাহ করে না, না দেখেও সাক্ষ্য দেয় এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কথা বিশ্বাস করে। কিন্তু হে ইমাম! এসব তো কুফুরি। এই লোক সম্পর্কে আপনার ফতোয়া কি?” ইমাম আবু হানিফা রহ. জবাবে বলেন- ” আমার মতে লোকটি মুসলিম।” প্রশ্নকর্তাকে অবাক হতে দেখে ইমাম তাকে ব্যাখ্যা করে বলেন- “সে শুধুমাত্র আল্লাহকে চায় তাই তার কাছে জান্নাত তুচ্ছ, সে জাহান্নাম নয় বরং জাহান্নামের রবকেই বেশি ভয় পায়, সে মৃত মাছ ভক্ষণ করে যা শরিয়াতে বৈধ, সে জানাযার সালাত আদায় করে যাতে রুকু-সিজদাহ নেই, সে আল্লাহ ও রাসূল সা. কে না দেখে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দেয় এবং ইহুদি-খ্রিস্টানরা একে অপরকে বলে যে, তারা সত্যের উপর নয় -একথায় বিশ্বাস করে। আর এসব কারণ মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।” আহ! ইমামে আযমের এরূপ ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা যদি আমাদের থাকতো।
ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার অধিকারী মানুষের কাজ হল- সর্বদা মানুষকে রক্ষা করা, মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার করা এবং মানুষকে আশ্রয় দেওয়া। মানুষের ভুল ধরিয়ে দিয়ে তাকে সংশোধনের উপদেশ দেওয়া। সংশোধনের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা পরিশুদ্ধ ও ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা বিবর্জিত মানুষের কাজ।