ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ তথাকথিক আধুনিক মনষ্করা পরিবারের গুরুত্ব ও মর্যাদাকে অস্বীকার করে। তাদের বক্তব্য হল- বাবা-মা, ভাই-বোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন মিলে একতাবদ্ধ জীবন যাপন করলে তাতে বরং ক্ষতি বেশী। বাবা-মা’র শাসন ছেলে-মেয়েদের বুদ্ধিবৃত্তিকে ক্ষুন্ন করে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে। পরিবারে স্ত্রীরা স্বামীদের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তারা একপ্রকার দাসী হয়ে জীবন অতিবাহিত করে। বোনরা ভাইদের দ্বারা নিগৃহিত হয় এবং পরিবারে তাদের যোগ্যতা ও মেধা বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না। সর্বপোরি পরিবারে নারী-পুরুষের মাঝে অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অসম যুদ্ধ চলে। যা মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন জীবন যাপনের পথে প্রধান অন্তরায়।
পরিবারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা এসকল বক্তব্য যুক্তি নয় বরং অভিযোগ। যা বিভিন্ন পরিবারে পরিচালনগণত ক্রটির কারণে ঘটে থাকে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অধিকাংশ পরিবারের অব¯’া এমন-ই। কিš‘ এসকল অভিযোগের কারণে পরিবারকে অস্বীকার করার কী যুক্তি থাকতে পারে; যখন বিশে^র সফল ও কৃতি মানুষগুলো তাদের জীবনে সাফল্যের মূলমন্ত্র হিশাবে পরিবারের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার কথা সর্বত্র বলে বেড়ায়। কাজেই কোন একটি জাহাজকে উল্টো পথে পরিচালনা করে কিভাবে ইঞ্জিনের দোষ দেয়া যায়!
প্রত্যেক মানুষের জন্ম থেকে আরম্ভ করে খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরি”ছদ, হাঁটাচলা, খেলাধুলা, কথাবার্তা, পড়ালেখা, চিন্তা-চেতনা, চরিত্র, বিয়ে-শাদী, পেশাদারিত্ব ইত্যাদি সবকিছুতে পরিবারের অনবদ্য ভূমিকা থাকে। পরিবার ব্যতীত কে আছে এমন যে, নিজে নিজে খেতে শিখেছে, হাঁটতে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে, খেলতে শিখেছে অথবা লিখতে বা পড়তে শিখেছে? গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুরা বাবা-মা, ভাই-বোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বড় হয় তারা আর যে শিশুরা একাকী বড় হয়, তাদের মাঝে বোধ ও বুদ্ধির পার্থক্য থাকে বিরাট । একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া শিশুরা হয় আত্মবিশ^াসী ও প্রত্যুৎপন্নমতী। বিপরীতে একাকী বড় হওয়া শিশুরা হয় অন্তর্মুখী ও মানসিকভাবে দুর্বল।
সঠিকভাবে পরিবার গঠন, নেতৃত্ব প্রদান ও মূলনীতি অনুসরণ করে পরিবার পরিচালনার যে নির্দেশনা ইসলাম প্রদান করেছে, তা যদি মেনে চলা হয়, তাহলে কোন পরিবারের প্রতি অনুরূপ অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে না। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে লক্ষ্য ও উদ্দেশে পরিবার সৃষ্টি করেছেন, তা হল প্রত্যেক মানুষকে স্বাধীন সত্তা হিশাবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করা। যে স্বাধীন সত্তার বৈশিষ্ট্য হল- নিজে সুখ, শান্তি, দয়া ও ভালোবাসার ধারক-বাহক হওয়া এবং অন্যদের মাঝে তা ছড়িয়ে দেওয়া। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,
وَمِنْ ءَايَـٰتِهِۦٓ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَٰجًۭا لِّتَسْكُنُوٓا۟ إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةًۭ وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَـَٔايَـٰتٍۢ لِّقَوْمٍۢ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থঃ আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে স্ত্রীদের (পরিবার) সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ করো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে (আল্লাহর অস্তিত্বের) নিদর্শন। [সূরা রূম : ২১]
মুসলিম পরিবারগুলো কখনো প্রচলিত পরিবারের মতো হওয়া উচিৎ নয়। যেখানে শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও কোনপ্রকার জবাবদিহিতা নেই। নেই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পিতা-মাতা জানে না কেন তারা পরিবার গঠন করেছে, স্বামী-স্ত্রী জানে না কেন তারা সংসার করছে, ছেলে-মেয়েরা জানে না তাদের কি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ভাই-বোনরা জানে না তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কী। তারা পরিবারবদ্ধ থাকে কেবল সামাজিক রীতি হিসেবে। অথচ মুসলিম পরিবারগুলো ও তাদের পারিবারিক জীবন এক মহান লক্ষের দিকে পরিচালিত। আর তা হল, একদল নৈতিকতাসম্পন্ন ও যোগ্য মানুষ তৈরী করা Ñযারা বিশ^ময় শান্তি ও স্বস্তির বার্তা ছড়িয়ে দিবে। পবিত্র কোরআনে এ মর্মে বলা হয়েছে,
کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ
অর্থঃ তোমরা হলে সর্বোত্তম জাতি, যাদেরকে মানুষের কল্যাণে বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে। [সূরা আলে-ইমরান : ১১০]
আরও বলা হয়েছে,
وَلۡتَکُنۡ مِّنۡکُمۡ اُمَّۃٌ یَّدۡعُوۡنَ اِلَی الۡخَیۡرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে এমন এক জাতি থাকা উচিৎ যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর তারা হবে সফলকাম। [সূরা আলে-ইমরান : ১০৪]
ইসলামী শরীয়াহর গুরুত্বপূর্ণ একটি ‘মাকাসিদ’ বা উদ্দেশ্য হল, বংশ সংরক্ষণ করা। এতদুদ্দেশ্যে বিয়ে করা, পরিবার গঠন ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করাকে ওয়াজিব করা হয়েছে। পরিবারকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যে ‘মাহরাম’ নারী ও পুরুষের মাঝে বিয়ে হারাম করা হয়েছে এবং ব্যভিচারকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাতে সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে ‘রেহেম’ বা আত্মীয় সম্পর্কের যে ধারা প্রবাহিত হয়েছে, তা যেন কোনক্রমে কলুষিত না হয়। সুতরাং সার্বিক দিক বিবেচনায় পরিবারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
মুসলিম পরিবারগুলোর মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। তন্মধ্যে যে ঘরে মুসলিমরা বসবাস করে তার মর্যাদা মসজিদের পরেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মুসলিমদের এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, তারা যেন বিনা অনুমতিতে অন্যের ঘরে প্রবেশ না করে এবং প্রবেশ করার পূর্বে যেন অবশ্যই সালাম করে। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَدۡخُلُوۡا بُیُوۡتًا غَیۡرَ بُیُوۡتِکُمۡ حَتّٰی تَسۡتَاۡنِسُوۡا وَ تُسَلِّمُوۡا عَلٰۤی اَهۡلِهَا ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা বিনা অনুমতিতে অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না এবং প্রবেশের পূর্বে গৃহবাসীদেরকে সালাম করো। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। [সূরা নূর : ২৭]
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِیَسۡتَاۡذِنۡکُمُ الَّذِیۡنَ مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ لَمۡ یَبۡلُغُوا الۡحُلُمَ مِنۡکُمۡ ثَلٰثَ مَرّٰتٍ ؕ مِنۡ قَبۡلِ صَلٰوۃِ الۡفَجۡرِ وَ حِیۡنَ تَضَعُوۡنَ ثِیَابَکُمۡ مِّنَ الظَّهِیۡرَۃِ وَ مِنۡۢ بَعۡدِ صَلٰوۃِ الۡعِشَآءِ ۟ؕ ثَلٰثُ عَوۡرٰتٍ لَّکُمۡ ؕ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ وَ لَا عَلَیۡهِمۡ جُنَاحٌۢ بَعۡدَهُنَّ ؕ طَوّٰفُوۡنَ عَلَیۡکُمۡ بَعۡضُکُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمُ الۡاٰیٰتِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাসদাসি ও অপ্রাপ্তবয়স্করা যেন (তোমাদের ঘরে আসতে) তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে -ফজরের পূর্বে, দুপুরে প্রচন্ড রোদে তোমরা যখন পোশাক খুলে রাখ এবং ‘ইশার পর। এ তিনটি তোমাদের পোশাকহীন হওয়ার সময়। এ সময়গুলো ছাড়া অন্য সময়ে (ঘরে প্রবেশ করলে) তোমাদের জন্য এবং তাদের জন্য কোন দোষ নেই। যেহেতু তোমাদের একে অন্যের কাছে আসাযাওয়া করতে হয়। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশ বর্ণনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান। [সূরা নূর : ৫৭-৬৮]
মুসলিমদের ঘরে ফেরেশতারা বিচরণ করে। ফলে ঘরে কুকুর বা ছবি রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
لاَ تَدْخُلُ الْمَلاَئِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ وَلاَ تَصَاوِيرُ
অর্থঃ ফেরেশতা ঐ ঘরে প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর ও ছবি থাকে। [সহীহ বুখারী]
মসজিদের পর ইবাদত-বন্দেগীর ¯’ান হল মুসলিমদের ঘরগুলো। ফলে রাসূলুল্লাহ সা. মুসলিমদেরকে তাদের ঘরে কিছু হলেও সালাত আদায়ের নির্দেশ প্রদান করে বলেন,
اجْعَلُوا فِي بُيُوتِكُمْ مِنْ صَلاَتِكُمْ وَلاَ تَتَّخِذُوهَا قُبُورًا
অর্থঃ তোমরা ঘরে কিছু হলেও সালাত আদায় করবে। ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করবে না। [সহীহ বুখারী]
ঘরে প্রবেশের নিয়ম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
إِذَا وَلَجَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ، فَلْيَقُلْ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَ الْمَوْلَجِ، وَخَيْرَ الْمَخْرَجِ، بِسْمِ اللَّهِ وَلَجْنَا، وَبِسْمِ اللَّهِ خَرَجْنَا، وَعَلَى اللَّهِ رَبِّنَا تَوَكَّلْنَا، ثُمَّ لِيُسَلِّمْ عَلَى أَهْلِهِ
অর্থঃ যখন কেউ নিজ ঘরে প্রবেশ করবে তখন সে যেন বলে, “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আগমন ও প্র¯’ানের কল্যাণ চাই। আপনার নামে আমি প্রবেশ করি ও বের হই এবং আমাদের রব আল্লাহর উপর ভরসা করি।’’ অতঃপর সে যেন তার পরিবারের লোকদের সালাম করে। [আবু দাঊদ]
কাজেই এ থেকে বুঝা যায়, মুসলিমদের জীবনে তাদের পরিবারের গুরুত্ব ও মর্যাদা কতখানি।