প্রাসঙ্গিকতাঃ
বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্পোন্নয়ন, পুঁজিবাদ, বস্তুবাদ, বিশ্বায়ন ইত্যাদির প্রভাবে বিগত ১০০বছরে মানুষের জীবনে ইসলাম ও মুহাম্মদ সা. এর প্রয়োজনীয়তা যেন তিলেতিলে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে তাঁর জীবন পদ্ধতি বা তরিকাহ বিরাট চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে গেছে। বহুবিধ যুক্তিপ্রমাণ ও প্রজ্ঞা দিয়ে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষকে বুঝাতে হয়েছে বারংবার। ইসলাম প্রচারকরা প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন যে, আদৌ মুহাম্মদ সা. আনীত জীবন ব্যবস্থার দিকে মানুষ পুনরায় ফিরবে কি-না? অথবা কিভাবে ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং কিভাবেই বা সুন্নাহর পুনরুজ্জীবন ঘটতে পারে? এমনি হতাশাজনক পরিস্থিতিতে বিশ্ব যেন চলতি শতকের প্রারম্ভে এসে হুঁশ ফিরে পায়।
বিজ্ঞান ও টেকনোলজির প্রভাবে মানুষের জীবন একঘেঁয়ে ও বিরক্তিকর উপলব্ধি হতে আরম্ভ করে। মাত্রাতিরিক্ত গতিময় জীবনের প্রতি মানুষ ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠে। মানুষের এই বোধদয় হয়েছে যে, ক্রমাগত ছুটে চলার নাম জীবন নয়। প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিশ্রাম, মেডিটেশন এবং প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। মানসিক প্রশান্তির দিকে মানুষের দৃষ্টি এখন সবচেয়ে বেশি। ফলে জীবন-জীবিকার প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গিতে গুনগত পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তির কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে। বস্তুবাদি সমাজে একটা গভীর টেনশন তৈরি হয়েছে যে, এ কি জীবন, নাকি দাসত্ব? এমতাবস্থায় নবী মুহাম্মদ সা. এর জীবন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে পুনরায় গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আসুন আমরা এ মহামানবের সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে জানি এবং তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করি।
দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইঃ
দারিদ্র্য মানবজীবনের অবশ্যম্ভাবী এক বাস্তবতা। শৈশব থেকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে নবী সা. বড় হন। হজরত খাদীজা রা. নবী সা. এর জীবনে আসার পর তিনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেন। শৈশবে তিনি যে দুধ মাতার গৃহে লালিতপালিত হন, তা ছিল খুবই দরিদ্র একটি পরিবার। যেখানে আহার বলতে ছিলো শুধুমাত্র শুকনা রুটি এবং মাঝেমধ্যে দুধ। সেখান থেকে ফিরে গর্ভধারিনী মায়ের ইন্তিকালের পর যখন তিনি চাচার গৃহে আশ্রয় নেন -সেটিও ছিল অভাবের সংসার। নবী সা. তাই চাচার ক্ষুদ্রব্যবসায় সহযোগী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন এবং সেখানেও তিনি খুব অল্প আহার করতেন। চাচার মৃত্যুর পর তিনি আশ্রয় নেন দাদা আব্দুল মুত্তালিবের গৃহে; যিনি ছিলেন অতিশয় বৃদ্ধ ও কর্মক্ষম। নবিজী এ সময় হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন এবং খুবই সামান্য বিনিময়ে খেজুর বাগানে সেঁচের কাজ করতেন। কখনো ভারি মালামাল বহন করতেন, কখনো উট চরাতেন এবং কখনো উটের দুধ দোহন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য অধৈর্য হননি এবং কোনপ্রকার দুর্নীতিতে জড়াননি। পরিশ্রম, মেধা ও সততা অক্ষুণ্ণ রেখে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। চারদিকে তাঁর সততা, আমানতদারিতা ও দক্ষতার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে তিনি একদা তৎকালিন সময়ের প্রসিদ্ধ নারীব্যবসায়ী হজরত খাদিজাতুল কুবরা রা. এর প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহীর (ceo) দায়িত্ব লাভ করেন। নবী সা. অত্যন্ত সার্থকতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন এবং এ সময় তাঁর জীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতা দেখা দেয়।
(শিক্ষাঃ পরিশ্রম, দক্ষতা ও সততা ব্যতীত দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি লাভ করা যায় না।)
প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্কঃ
প্রকৃতির (nature) সাথে নবী সা. এর ছিলো গভীরতম সম্পর্ক। শৈশবে তিনি মেষ চরাতেন, দুধ দোহন করতেন, বিস্তীর্ণ মাঠ, সবুজ ঘাস ও পাহাড়ের পাদদেশে সময় কাটাতেন। তিনি আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন না এবং গালগল্পে লিপ্ত হতেন না। নির্জনতাকে অধিক পছন্দ করতেন। আরবের উঁচু উঁচু পাহাড়, গুহা, গাছ-পালা, পশু-পাখি, মরুভূমির উষ্ণতা, বালি, রোদ-বৃষ্টি ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং এসবের মাঝে মহান রবের অস্তিত্ব খুঁজে পেতেন। প্রকৃতির সাথে তিনি এমনভাবে মিশতেন যেন তারা তাঁর কথা বুঝতো এবং তিনিও তাদের কথা বুঝতেন। ফলে পবিত্র কোরআনে আল্লাহর পরিচয় প্রসঙ্গে এসব জিনিসের কথা এত বারবার উল্লেখ করা হয়েছে; যেন মানুষ এসব থেকে দূরে সরে না থাকে। মানুষ যাতে সবসময় আল্লাহর বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি তথা প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকে এবং তাঁর অস্তিত্বকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। কেননা এটি ঈমানকে মজবুত ও সজীব করে তোলে।
(শিক্ষাঃ প্রতিটি মানুষের উচিৎ প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে থাকা। এতে জীবন অর্থবহ ও শিক্ষনীয় হয়।)
নিভৃতচারিতাঃ
নবী সা. নবুয়ত লাভের পূর্বে দিনের একটি অংশ একাকী নিভৃতে কাটাতেন। এটি হতো কখনো সপ্তাহব্যাপী, কখনো মাসব্যাপী এবং কখনো কখনো তার চেয়েও বেশী সময় প্রলম্বিত হতো। এটা এজন্য নয় যে, তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন কিংবা সংসার বিরাগী ছিলেন। বরং নিভৃতে নিজের চিন্তার দুয়ারকে তিনি উন্মুক্ত করে দিতেন এবং নিজের আধ্যাত্মিক চেতনাকে শাণিত করতেন। এরমাধ্যমে নবী সা. জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতেন এবং একান্তে মহান রবের সাহায্য কামনা করতেন। পরবর্তীতে তাঁর এই অনুপম অভ্যাসকে ইসলামি শরীয়াহর বিধান হিসাবে উম্মাহর জন্য অবধারিত করে দেওয়া হয়। যার নাম হল- ই’তিকাফ।
(শিক্ষাঃ নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।)
দুশ্চিন্তা ও হতাশাঃ
নবী সা. এর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে নানাবিধ দুঃখ-কষ্ট আবর্তিত হয়েছে এবং তা কোন অংশে কম নয়। যে কোন সাধারণ মানুষের তুলনায় তাঁর দুঃখ-কষ্টের পরিমাণ ছিলো বেশী এবং অবর্ণনীয়। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাঁকে প্রায়শই হতভম্ভ করে দিতো কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য তিনি বিচলিত হতেন না। তিনি চিন্তিত হতেন কিন্তু হতাশ হতেন না। পিতৃ-মাতৃহীনতা, অভাব-অনটন ও আশ্রয়হীনতা তাঁকে ভাবিয়ে তুলতো কিন্তু দুশ্চিন্তা গ্রাস করতে পারতো না। জীবনের প্রতিটি দুঃখ-কষ্টকে তিনি এক অমোঘ সত্য দ্বারা প্রতিনিয়ত সারিয়ে তুলতেন। আর তা হল- “নিশ্চয়ই মহান রব তাঁকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন।” ফলে তাঁর জীবনে যা কিছু ঘটছে, তার সবই সে উদ্দেশ্যের দিকে ধাবমান। এতে দুশ্চিন্তা বা হতাশার কিছু নেই।
রুটি-রুজির সংকট তাঁর কাছে কখনো দুশ্চিন্তা বা হতাশার বিষয় ছিল না। এমনকি প্রিয়জনদের কাছে দ্বীনি কারণে রাতারাতি ‘প্রিয়’ থেকে ‘অপ্রিয়’ হয়ে যাওয়াও তাঁর জন্য দুশ্চিন্তার কোন বিষয় ছিল না। কিন্তু সমগ্র জীবনে তিনি শুধুমাত্র একটি বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সইতে পারেননি। আর তা হল, অল্প কিছু দিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসা বন্ধ থাকা। যা ছিলো মাত্র ছয় মাস সময়কাল [যাকে ইসলামি পরিভাষায় আল-ফাতরাহ বলা হয়]। উম্মুল মু’মিনীন হজরত আঈশা রা. নবী সা. এর সে সময়কার অবস্থার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, “এ সময় আল্লাহর রাসূল এতটাই হতাশ এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, তিনি বেশ কয়েকবার উপর থেকে নিজেকে ফেলে দেয়ার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন করেন। কিন্তু যখনই তিনি নিচের দিকে তাকাতেন; জিব্রাইল আ. উপস্থিত হয়ে যেতেন এবং বলতেন- ‘নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল।’ এতে তিনি শান্ত হয়ে যেতেন।” [বুখারী]। বস্তুত এটি হল, নবী সা. থেকে প্রকাশিত দুশ্চিন্তা ও হতাশা বিষয়ক একমাত্র গ্রহযোগ্য শিক্ষা। অর্থাৎ- মানুষ কেবলমাত্র তাঁর রবের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে চিন্তিত ও হতাশ হতে পারে। অন্যথায় কোন জীবনোপকরণ লাভ কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য চিন্তিত ও হতাশ হতে পারে না।
(শিক্ষাঃ প্রভূর সান্নিধ্য হারানো ব্যতীত জীবনে দুশ্চিন্তা ও হতাশার কিছু নেই।)
নিরবতাঃ
নিরবতা ছিল নবী জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর চেয়ে বেশী কে জানতো? অথবা কে বলতে পারতো? কিন্তু তিনি নিরবতাকেই অধিক পছন্দ করতেন। তাঁর নিরবতা ইসলামী শরীয়াহর দলিল হয়েছে এবং কেউ নিরব থাকতে চাইলে তাকে জোর করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। নবী সা. যেমন সর্বদা ভেবেচিন্তে কথা বলতেন, অনুরূপভাবে উম্মাহকেও তিনি ভেবেচিন্তে কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে আর না হয় নিরব থাকে।” এবং “যে নিরব থাকে সে পরিত্রাণ লাভ করে।”
(শিক্ষাঃ বিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা লাভ করতে হলে পরিমিত কথা বলা শিখতে হবে।)
মন্দ লোকদের বিষয়ে কর্মপন্থাঃ
প্রতারক, মুনাফিক ও দুষ্টু লোকদের বিষয়ে নবী সা. এর পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত ও কার্যকরী। নবী সা. ধরেই কোন প্রতারক, মুনাফিক বা দুষ্টু লোককে শাস্তি দিতেন না বা দমন করতেন না। প্রথমতঃ তিনি বুঝামাত্র ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যেতেন। তবে দাওয়াতি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও নবী সা. বিশ্বাসঘাতক ও মুনাফিকদেরকে প্রকাশ্যে ট্যাগ করতেন না। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে তিনি কখনো মুনাফিক বলে ট্যাগ করেননি। যদিও সাহাবীগণ এ বিষয়ে তাঁর সাথে দ্বিমত করতেন। তবে যখন কেউ সীমালঙ্ঘন করতো এবং অপরাধ সাব্যস্ত হলে নবী সা. তাকে সমুচিত শাস্তি দিতেন। যেমন, খাইবার যুদ্ধে মারাত্মক প্রতারণার কারণে বনু কুরাইজার পুরুষদেরকে তিনি সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। বস্তুতঃ নবী সা. তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেননা ইতিমধ্যে সর্বত্র একটি কথা রটে যায় যে, ‘মুহাম্মদ সা. অত্যন্ত দিলদরিয়া মানুষ; তাঁর কাছে যে কোন উপায়ে ক্ষমা লাভ করা যায়।’ ফলে যখন তিনি বনু কুরাইজার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহন করেন; সাথে সাথে প্রতারক, মুনাফিক ও দুষ্টু লোকেদের বুকে কাঁপন ধরে যায় এবং তাদের তৎপরতা লোপ পায়। সংক্ষেপে প্রতারকদের বিষয়ে নবী সা. এর নীতিসমূহ হলঃ
১. প্রতারণার ব্যাপারে সবসময় সজাগ থাকা।
২. প্রতারণা ধরতে পারার সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যাওয়া।
৩. প্রতারক চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও ট্যাগ না দেওয়া।
৪. যতটা সম্ভব সহনশীলতা দেখানো।
৫. সীমালঙ্ঘন করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা।
(শিক্ষাঃ মন্দ লোকদের বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকা।)
নারীদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গিঃ
পৃথিবীর ইতিহাসে নারীরা নবী সা. ব্যতীত অন্য কারো কাছে এত সুউচ্চ মর্যাদা পায়নি। তাঁর জীবন ও উপদেশ আমাদেরকে এ কথা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে, নারীদের অমর্যাদা করে, তাঁদেরকে পিছিয়ে রেখে, তাঁদের সাথে ছলচাতুরি করে অথবা তাঁদের সহযোগিতা ও সমর্থন ছাড়া কোন পুরুষ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। তিনি নিজেই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নবী সা. সবসময় তাঁর জীবনে দুধমাতা হালিমাতুস সা’দিয়ার অবদানের কথা স্বীকার করতেন এবং প্রকাশ্যে বলতেন। তাঁকে তিনি অভূতপূর্ব সম্মান করতেন। তাঁর জীবনে হজরত খাদিজা রা. এর অপরিসীম অবদানের কথা তিনি বহুবার কেঁদে কেঁদে বলেছেন। তাঁর প্রতি নবিজীর অপরিসীম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাবোধ দেখে স্বয়ং আয়েশা রা. প্রকাশ্যে বলতেন যে, “একমাত্র খাদিজা রা. এর প্রতি তাঁর হিংসা হয়।” তিনি নিজেও নবী সা. এর প্রিয়তমা একজন স্ত্রী ছিলেন। নবী সা. তাঁকে নারীদের শিক্ষাদান কাজে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলেন এবং ব্যক্তিগত সচিবের মর্যাদা দান করেন।
নবী সা. তাঁর নিজস্ব পরিসরে অর্থাৎ আত্মীয় নারীদের সাথে এতটাই মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতেন যে, সবাই তা দেখে বিস্মিত হতো। এতে অধিকাংশ সাহাবী তাঁদের স্ত্রীদের ব্যাপারে এতই সতর্ক হয়ে যান যে, ঘরে প্রবেশ করা মাত্র তাঁরা যেন বোবা হয়ে যেতেন। এতে দেখা গেল যে, এই ঘর ওই ঘর থেকে ক্রমান্বয়ে শুধুমাত্র নারীদের চিৎকার-চেঁচামেচিই ভেসে আসতে লাগলো। এমতাবস্থায় নবী সা. কে পুনরায় নারীদের এই বলে সতর্ক করে দেওয়ার প্রয়োজন হল যে, যে সকল স্ত্রী লোকদের গলার স্বর অন্য পুরুষ শুনতে পায়; তারা খিয়ানতকারিনী।
নবী সা. তাঁর জীবনের শেষ ভাষণে উম্মাহর প্রতি যে কয়টি মহামূল্যবান উপদেশ দিয়ে যান তন্মধ্যে একটি হল, নারীদের সাথে ভালো আচরণ এবং তাঁদের অধিকার যথাযথভাবে আদায় করা। তিনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে এ মর্মে চূড়ান্ত সতর্ক করে দিয়ে যান যে, “নারীদের ব্যাপারে তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।”
(শিক্ষাঃ নারীদের যথাযোগ্য সম্মান ও অধিকার প্রদান করা ব্যতীত মানব সমাজ (পুরুষরা) কখনো মুক্তি লাভ করতে পারে না।)
নবী সা. এর যোগ্যতাবাদঃ
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রতিটি মানুষের যোগ্যতা (ability) অর্জন করাকে নবী সা. সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে যোগ্যতম মানুষ। সেরা জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, কর্মবীর, মহান ও বাস্তববাদী। যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে এগুলো ছিলো তাঁর সুন্নাহ। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, যোগ্যতা অর্জন করা ব্যতীত সাফল্য লাভ করা যায় না এবং ক্ষণিকের জন্য সফল হওয়া গেলেও তা টেকসই হয় না। তিনি মনে করতেন, যোগ্যতা অর্জন মানে হল- মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং দুর্বলতা, অপরিপক্কতা, লোকদেখানো ও চটকদার মুক্ত হওয়া। নবী সা. তাঁর সমগ্র জীবনে যোগ্যতা অর্জনের প্রশ্নে এতটাই সতর্ক ছিলেন যে, এক মুহূর্তের জন্য তিনি এ বাস্তব চিন্তা থেকে সরে আসেননি। মক্কায় তিনি চরম ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন কিন্তু একটিবারের জন্যও প্রতিরোধের চিন্তা করেননি। বরং প্রতিনিয়ত সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন যে, কিভাবে সবাইকে রক্ষা করা যায় এবং শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। ফলশ্রুতিতে তিনি সবাইকে পরিস্কারভাবে বলে দেন যে, আমাদের এখনো প্রতিরোধের যোগ্যতা অর্জিত হয়নি। আমরা বড়জোর হিজরতের কথা ভাবতে পারি। তাঁর এ চিন্তাসূত্র ধরে নওমুসলিমগণ প্রথম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। অতঃপর প্রবল প্রতিরোধের মুখে তিনিসহ সকল মুসলিম হিজরত করেন মদীনায়। এতে একটি বিষয় খুব পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, যোগ্যতা অর্জিত হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হয়; যেটি তিনি মক্কায় করেছিলেন। এর ফলে তিনি যে অভূতপূর্ব শক্তি অর্জন করেন তার সুদূরপ্রসারি ফলাফল লাভ করেন মক্কা বিজয়ের মধ্যদিয়ে। যে বিজয় ইসলামের ভিত্তিকে চিরস্থায়ীভাবে বিশ্বের বুকে গেঁড়ে দেয়।
(শিক্ষাঃ যোগ্যতা ও সামর্থ অর্জন করা ব্যতীত নেতৃত্ব অর্জন করা যায় না এবং তা টেকসই হয় না।)
নবী সা. এর কর্মতৎপরতাঃ
নবী সা. ছিলেন একজন কর্মতৎপর মানুষ। তিনি ছিলেন প্রোএক্টিভ (proactive)। যিনি অন্যের অনুপ্রেরণা ছাড়াই কাজ করতেন এবং কারো জন্য বসে থাকতেন না। নিজের আয়-রোজগারের পাশাপাশি সমানতালে মানুষের জন্য সহায়তামূলক কাজ করতেন। যেমন, তিনি বিনা পয়সায় রাস্তা মেরামত করে দিতেন, নিঃসঙ্গদের থালা-বাসন পরিস্কার করে দিতেন, অসহায়দের বাজার করে দিতেন, বয়স্কদের ভারি বোঝা কাঁধে করে পৌঁছে দিতেন। এক বৃদ্ধা মহিলার ভারি ভারি বোঝা প্রায়ই তিনি বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। এর অর্থ হল নবী সা. কখনো অলস বসে থাকতেন না এবং সব কাজকে তিনি পারিশ্রমিকের বিপরীতে দাঁড় করাতেন না। ফলে সুনির্দিষ্ট কিছু কাজে তিনি পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন আর কিছু কাজে করতেন না।
নবী সা. কোন কাজকে ক্ষুদ্র চোখে দেখতেন না। তিনি বলেছেন, “সে ব্যক্তি উত্তম, যে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করে।” (উপার্জন মানে শুধু টাকা-পয়সা নয়। বরং সম্মান, স্নেহ, মায়া-মমতা, দোয়া, ভালোবাসা ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত।) নবী সা. এর অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি কাজের জন্য কখনো বসে থাকতেন না। নিজের মেধা ও বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ তৈরী করে নিতেন এবং সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
(শিক্ষাঃ কর্মতৎপর হওয়া ব্যতীত জীবনে সফল হওয়া যায় না।)